দ্যা প্রাইস অব ফ্রিডম


ট্রাশম্যানিয়াক – দু-চাকায় আলাসকা থেকে টরোনটো


গল্পের শুরুটা কিভাবে করা যাবে সেটা বুজতেই মনে হয় বেশি সময় লেগে গেল। এতটা লম্বা সফর আগে দেয়া হয়নি বলে মনে হয় সময়টার লাগাম টানতে পারছিলাম না বা টানতে কষ্ট হচ্ছিল।

সাইকেল নিয়ে ঘুরাঘুরির মারাত্বক বদ অভ্যাসটা আমার নিয়মিত একটা ব্যপার হয়ে গেছে মনে হয়। দেখতে দেখতে কত গুলো সময়। কতগুলো ঘটনা। কতগুলো নতুন জায়গা। সব নতুনের মাঝে প্রতিবারের মত একটাই পুরাতন আমি। প্রায় দুই বছর আগে আমেরিকার পশ্চিম থেকে পূর্বে সাইকেলে পাড়ি দিয়ে ছিলাম উজ্জল ভাইয়ের সাথে। সে বার ট্রিপ দেয়ার আগে মনে হয়েছিল – আমার স্বাধীনতার সর্বোচ্চ প্রাপ্তি মনে হয় এটাই হতে পারে। তাই প্রতিবারের মতো সব পিছুটান ছেড়ে মাসখানেকের জন্য রাস্তায় নেমে পরেছিলাম।

কি পেলাম বা না পেলাম সেটার হিসাব এখনো মেলানো হয়নি। তবে সময়ের মত রাস্তা গেছে শেষ হয়ে তবে আমার হিসেবের খাতার ফলাফল এখোনো দেখা হয়নি।

আর এবারের ঘটনা গত বারের পুনাবৃত্তি কিনা সেটা আমি নিজেও জানি না। কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকে মনে হয় এমনটা হয়। কি হবে, কি ভাবে হবে কোন উত্তরই তখন জানা থাকেনা বা জানাও হয়েওঠেনা। তাও কেন জানি বিভ্রান্ত কিংবা উদ্ভন্তের মতো ঝাপিয়ে পরা হয়! আমার নিজের স্বাধীনতার বহিপ্রকাশ মনে হয় এটাই।

জল্পনা কল্পনার শুরু অনেকদিন আগে থেকে। তবে এবার একা নয় বাংলাদেশ থেকেই। প্রিয় মানুষ কনক ভাই যাবেন অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন। সপ্তাহন্তে আমাদের আড্ডা হতো – কখনও জলের গানের প্যাক্টীসপ্যাডে, কখনও বা কেবি ডেনে আবার কখনও বা কাটাবনে ভ্রমণসঙ্গীতে। আলোচনা-ভালচনায় কি হতো বা কি গুরুত্বই বা ছিল জানি না, তবে তখন দারুন লাগতো। কেমন জানি একটা ঘোরের মতো ব্যপার। এমন একটা ঘোর যার জন্য আমরা দুজনই মনে মুখিয়ে থাকতাম।

আমার মেজাজটা মনে হয় বেশ চড়া আর কনকেরটা মনে হয় একেবারের নাই নাই ভাব। তাই উচ্চবাচ্চ যা হতো সব আমার কাছ থেকেই উনি কেবল শুনেই যেতেন। দেখতে দেখতে সময়ও হয়ে আসছিল। কেমন করে বছর গড়িয়ে যেতে পারে তা আমরা নিজেরাই কতবার ডিসকাস যে করেছি বলার না। সময়! কি অদ্ভুত একটা কিছু।

বছরের শুরু দিকে আমাদের সাথে যোগ দিল সারাহ-জেন। হলাম আমরা তিন জন। অন্যদিকে আমার পুরোনো বন্ধু ক্রিসেরও যোগ দেবার কথা। তো হবে চার। যাইহোক, এখন আমরা তিনজন। তাই নিয়মিত আড্ডায় ঠিকঠাক করে নেয়া হলো কার কাজ কি হবে। মজার ব্যপার হলো, প্রতিবারের মত কোন ঘটনা ঘটনার আগে যেভাবে ভাবা হয়, ঘটে যাবার পর মনে, আয় হায় এমন করে তো হবার কথা ছিল না।

বিশাল কিছু করে ফেলার আগাম অধিবার্তায় আমরা কেউ তলিয়ে গিয়েছিলাম না। না আমাদের উপর কেউ লগ্নি করেছিল, না আমরা কোন লগ্নি পেয়েছিলাম বা পেতে চেয়েছিলাম। তাই মনে হয় যে ডামাডোলটা আমরা ঘটলাম ঢাকা ছাড়ার আগে সেটাকে প্রেস কন্ফারেন্স বলাটা বেশ কঠিন। লম্বা লম্বা কথা আর বিশাল আস্বাসের গল্প আমরা তখনও করতে পারি নাই আর মহাভারত উদ্ধারের প্রতিশুতিও দেয়া সম্বব হয়নি।

নিউইয়র্কে আমাদের কাজের মধ্যে ছিল সাইকেল ঠিক করা আর দরকারি জিনিসপত্র গুলো কিনে নেয়া। যেকোন ট্রিপে যাবার আগে আমার মনের মধ্যে আমার শরীরের মধ্যে কেমন জানি করে ওঠে। বিশাল একটা হালকা বাতাসের দলা পাকিয়ে থাকে বুকে, যা এখনও গেছে কিনা জানি না। কি হবে, কি ভাবে হবে – এটাই মনে হয় খালি। ঠিক মতো হবে তো? হালকা বাতাসের দলার সাইজ যখন বড় হয়ে যায় তখন মনে হয় আমাকে অনেক অস্থির দেখায় । এর জন্য আমি নিজে দায়ী কিনা জানি না।

আকাস্কার আকাশে যখন আমাদের বিমান, অস্তিরতার পরিমান মনে হয় অনেক বেশি ছিল। প্রায় দুই বছরের পরিকল্পনার ক্রান্তিল্গনই বলা যায়। বিশাল একটা ক্লাইমেস্ক। আমার হালকা হাওয়ার দলার সাইজ এখন মনে হয় সবথেকে বড় অবস্থায়!

মনিকা ফোর্ড। আমাদের বন্ধু কেন ফোর্ডের বোন। থাকে এঙ্করেজে, আলাস্কার রাজধানী। আমাদের রাইড শুরু হবে ওখান থেকেই। মনিকার সাথে সারাহ-জেনের দেখা হোল আমার আর কননের আগে। আমরা দূর থেকেই দেখতে পেলাম বেশ আমুদে মানুষটিকে। ভাল লাগল। তার আতিথিয়তাই আমাদের পরের ২ দিন।

আলাস্কায় যখন নামলাম সেটাক রাত বলা গেলনা। যদিও বা ঘড়ির কাটা আটকে নেই। রাতইতো হবার কথা! কিন্তু কৈ? রাত ১১টায় তোমরা কি গ্লেসিয়ার দেখতে চাও? ক্লান্ত না তো? যদি চাওতো আমি তোমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারি। আমরা একথায় রাজি। কি বিশাল মজা, রাতের বেলায় দিনের আলো । সারা জীবন শুনেই আসা হয়েছিল কিন্তু এবার দেখা হল ব্যাপারটা। মনিকার বাসায় যখন আমরা গেলাম তখন আসলেও অনেক রাত কিন্তু বুঝা খুব কঠিন।

আরইআই থেকে শেষ বারের মত সবকিছু জোগার করে নিলাম। তার আগে সাইকেলটাকেও ঠিকঠাক করা হলো। একটা ট্যান্ডেম আরেকটা সিঙ্গেল বাইক। দুটাই ফ্লোডিং।

জুন মাসের ১৬ তারিখ। আমরা শুরু করলাম। বেশ এবরোথেবরো ছিল শুরু টা। বাইটা মনে হ্িচ্ছল অনেক বেশি ভাড়ি। শুরুই করা যাচ্ছিলনা। তার খানিকটা পর আমরা শুরু করলাম।

আসলে তারপর যা ঘটেছে তার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য আছে কিনা জানি না। এক একটা দিন গোনার আগে আমি এক একটা মুহুর্ত অতিক্রম করা শুরু করলাম। এটা একটা বিশাল মজার ব্যাপার। আমার নিজের প্রতিটি স্ট্রোকে আমি যেমন সাইকেলটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, ঠিক তেমন করে আমার জীবন, আমার স্বাধীনতা, আমার ভবিষ্যৎ সবই এগিয়ে যাচ্ছিল না কমে যাচ্ছিল। কোনটা যে সঠিক, সেঠা আমার পক্ষ্যে বলাটা বেশ কঠিন। সময়কে অনুভব করার একটা মজার বাহন হলো সাইকেল। আমার দারুন লাগে যখন দেখি সাইকেলের ছোট চাকা কালো পিচের উপর দিয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যায়। সে চাকা আর আমার জীবনের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য আমি খুজে পাইনা। এগিয়ে যাওয়া আর সময় অতিক্রম করা – এ দুয়ে মিলেই জীবন।

আলাস্কার গল্প হয়তোবা আবার করা যাবে। তবে শুধু এটাই বলা যায়, যেখানেই যাওয়া হোকনা কেন একটা সময় পর সবকিছুর মধ্যেই আপনি আপনার নিজকে খুজতে থাকেন। আর তখনই মনে হয় একই পথ আপনি আবার মাড়িয়ে যাচ্ছেন। যে পথে আমরা কানাডার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তা সহজ ছিল না কঠিন ছিল আমি জানি না। আমি জানি আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের সবার একসাথে থাকতে হবে। প্রতিদিন সকালে উঠে ওটমিল দিয়েই শুরু হতো দিন। কেউকে খুব পছন্দ করতো তা বলা যাবে না মনে হয়। আমি তো একেবারেই না। তবে, করতে করতে একধরনের ভালবাসা জন্ম নেয়। আমারও মনে হয় তাই হয়েছিল। এখন মনে হয় ওটমিল খেতে আমার কতই না দারুন লাগতো।

আলাস্কায় পাহাড় আছে তাই যখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা হতো, তখন শরীরীক কষ্ট না হলেও ভয়াবহ গতির সাইকেলে বসে মাইলের পর মাইল নামতে আমার ভীত মন চুপসে যেত। আমি যে কতটা ভীতু তার প্রমান আমার সাইকেলের ব্রেক প্যাড! আবার যখন এই একই রকম পাহাড়ী পথে উথতে হতো, তখন আর বেশি কিছু মনে হতো না। শুধু মনে হতো, আহ! ঢাকা কত দারুন, আজ কাটাবনের আড্ডায় কি হচ্ছে, অফিসে দুপুরে আজকের ম্যনু কি! কি অমানুষিক কষ্টর সময় গুলোও কেমন জানি শেষ হয়ে যেত। এই দুই মুহুতেই আমার মনে হয়, হায় জীবন কতো ছোট। যত কষ্টকর হোক বা হোক যত আনন্দের, শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না!

বিশাল পাহাড় আর দারুন নদীর দেশ আলাস্কা আর আমাদের শুরুর প্রথম দুসপ্তাহ কাটে এখানে। প্রথম দুসপ্তাহ হলো সবথেকে কঠিন – শরীর তার মত করে বুঝে নিতে শুরু করে কি করতে হবে, ধীরে ধীরে ধাতস্ত হতে থাকে – যেমনটা ভেবে ছিলাম আর কেমনটা হচ্ছে সেই হিসাব মিলায় শরীর-মন। আমার মনে এটা একটা বিশাল ধাক্কা। সব রোমঞ্চ উবে যায় সকালের ভয়াবহ শীতে দাত মাজার সময়, সাইকেলে দিনের প্রথম যখন বসা হয় তখন আবার ৫ কিমি গতিতে যখন কোন পাহাড় ডিঙ্গাতে হয়। এসব রোমান্টিক ফিকসনের বাস্তব রুপ হলো বেচে থাকা।

ডোন্ট গিভ আপ সারাহ! লেটস পুশ লিটল হারডার। মাই নিজ্ আর বাসটিং, ক্যান ইউ পুশ হার্ডার প্লিজ। সাইকেল, রাস্তা, জীবন – সবগুলোই একই সূত্র ধরে এগিয়ে চলে। এরনামই মনে হয় জীবন, এরই নাম মনে হয় বেচে থাকা।

সিডর র‌্যাপিডস্ দিয়ে আমরা কানাডায় প্রবেশ করলাম। জীবনের প্রথম মনে হয় কোন ইমিগ্রেসন অফিসে এত কম সময় কাটালাম। বিশেষ আর কঠিন কোন প্রশ্ন করলো না জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেয়া অফিসার। বললনা কোথায় যাব, কি খাব, কত টাকা আছে। সাইকেল দেখলেন, কাগজে সীল দিয়ে আমাদের তিনজনকে ওয়েলকাম করলেন।

সিডর র‌্যাপিডস্ নামের ইউকন এর এই ছোট শহরে দু দিন থাকলাম। মনে হলো একটা দিন থাকা যায়। ভালমন্দ খাওয়া যায়। তাই হলো।

ইউকন বেশ বড় প্রভিন্স। আর তার উপর পাহাড়ী। আমাকে যদি পার্থক্য করতে বলা হয় ইউকন আর আলাস্কার – আমার পক্ষে আদৌও করা সম্ভব হবে কিনা আমি জানি না। শুধু এটাই বলতে পারি এখানে মানুষ আরও অনেক কম। কত কত মাইল আমরা চালিয়ে গেছি কোন বাড়ি দেখিনি। পথে গাড়ির সংখ্যাও গিয়েছিল কমে।

আমার ডান হাটু বিগড়ে যাওয়ার জন্য ইউকনের রাজধানী হোয়াইটহর্সে থাকলাম ৪ দিন। এখানেই আমাদের সাথে যুক্ত হলো ক্রিস। যার সাথে আমার দেখা হলো ১১ বছর পর। আমরা একসাথেই সাইকেল চালাবো এখান থেকে। সাথে আরও আছে সুইটজাল্যান্ডের সিমন আর মার্টিন নামের দারুন দুজন। আমরা ৩ জন হয়ে গেলাম ৬ জন।

লজিক-এন্টি লজিক দিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের প্রতি দিনের প্ল্যান। কৈ থাকা হবে, কি ভাবে যাওয়া হবে এসব করেই চলে গেল সময়। বড় দলের যেমন মজা আছে, আছে মজা হাড়াবার বিশাল ভয়।

ইউকন থেকে আলবার্টায় ঢুকলাম ব্রিটিশ কলম্বিয়া হয়ে। বিসি আসলেও কঠিন ছিল। এখন মনে হয় বিসি সবথেকে কঠিন ছিল। বিসিতে যে পাহাড় গুলো ছিল তা মারাতœক বিরক্তিকর। একটার পর একটা। আরেকটার পর আরেকটা। ছোট-বড়-মাঝারি। তার উপর জনমানবহীন জনপদে রাস্তার পাশে যেমন থাকতে হয়েছিল, থাকতে হয়েছিল কোন একটা হ্রদের পারে। হ্রদের পানি ফিল্টার করেই খাওয়া হতো। আমি আবার বলছি এখন যতটা রোমান্টিক মনে হচ্ছে তখন তেমনটা মোটেও মনে হয়নি। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে হিসু করার জন্য দাড়াতেও বেশ ভয় ভয় লাগতো ভাল্লুকের জন্য। এটা সত্যি আমরা ভাল্লুক দেখতে পাইছি বেশ কয়েকবার। কাছ থেকে, দূরে থেকে। একবার একটা ঠান্ডা গৃজলীর ছবি সবাই তুল্লো কিন্তু আমি ভীতু মানুষ অনেক দূরে সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। তাই মনে হয় আমার কাছে উপভোগের থেকে ভয়ের আনন্দটাই বেশি ছিল। ভয়ও একধরনের উপভোগের বিষয়।

আলবার্টার ব্যাস্ফ এ আমাদের যাবার কথা ছিল আগে থেকেই। ব্যান্ফ মাউন্টেন ফিল্ম ফ্যেস্টিভ্যাল ওর্য়াড ট্যুর আয়োজন করে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ দিন ধরে এই অর্গানাইজেশনের সঙ্গে কাজ করার জন্যই মনে হয় এক ধরনের হৃদ্রতা হয়েছিল। তাই এখানেও ৩টা দিন কাটালাম। এর মধ্যে আমাদের কেটে গেছে প্রায় ২ মাস। কনক ভাইয়ের পারিবারিক সমস্যার কারনে চলে যেতে হলো ক্যাগারি থেকে। ক্রিস নিজের মত করে তার প্ল্যান শুরু করেছিল অনেক আগে থেকেই। আর সিমন-মার্টিন ভ্যানকুভার আইল্যান্ডের দিকে চলে গেছে তাও অনেক দিন হলো। প্রথমবারের মত আমরা হলাম ২ জন, একটা ট্যান্ডেম বাইক।

এরপর সাসকাচিওনের তথাকথিক সমতল ভূমিই মনে হয় মারাতœক হয়ে দাড়াল আমাদের কাছে। দমকা বাতাস আর অল্প উচ্চতার লম্বা লম্বা পাহাড় গুলো দূর থেকে সাধারন মনে হলেও, শেষটায় এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি, সাসকাচিওয়ান মোটেও সোজা ছিল না। তবে অসাধারন মানুষের দেখা পেয়েছিলাম এখানে।

কৃষকেরা কেমন জানি সব জায়গাতেই এক রকম ভাল। তাদের মাত্রা তাদের মতই। বিশাল আতিথীয়তার স্বকীয়তা মনে হয় তাদেরই বেশি। কেন এমন? প্রশ্নটা আমার নিজের কাছেই বড় হয়ে গিয়েছিল। তার উত্তর পাওয়া হয়নি এখনও। পাবলিক ক্যাম্পগ্রাউন্ডে পানি আর স্টোভ না কাজ করার জন্য যে মাজুল অবস্থার মধ্যে আমরা পরে গিয়েছিলাম সেখান থেকে উত্তরণও পেয়েছিলাম এক ক্ষেতির সাহায্যেই। পরে তাদের বাড়িতেই খাওয়া হলো, তাবুও পাতা হলো না – থাকলাম তাদেরই ঘরে। আমাদের দেশেও এমনটা খুব অপরিচিত না। তবে এখানে কৃষকেরা গরীব না। তাদের জমির পরিমান আমাদের কৃষকদের থেকে অনেক অনেক বেশি। কতটা বেশি তার পরিমাপ কিভাবে দেয়া যায় তা আমার জন্য বেশ কঠিন। বিশ হাজার একর কত বড় আমি আসলে জানি না কিন্তু এটা জানি যে তা আমাদের কোন চাষীর এতটা জমি থাকার কথা না। মজার বিষয় হলো, জমির পরিমান যাই হোক, আত্বীক দিক দিয়ে মনে হলো তারা সবাই একই রকম।

সাসকাচিওয়ানের এলরোজে প্রথম বাংলাদেশীর দেখা পেলাম এতদিন পর। সেটাও একটা বিশাল ব্যপার আমার জন্য। জীবনের এই প্রথম মনে হয় এমনটা হলো। আমাদের সাইকেলে বাংলাদেশের পতাকা ছিল, তাই থেকে ”বব ডাইনার” এর মালিক সেলিম ভাই, তার বউ লাকি আপা আর বন্ধু দিষা চিৎকার করে ডাকছিলেন। তার ঘরে বাংলা খাবার খেলাম ২ মাস পরে। সে কি বিশাল ব্যপার আমার জন্য। একটা বিষয় খুবই সত্য, আমি আদতে খুব ছোট ইসুতে অনেক বেশি খুশি হই মনে হয়।

ম্যনিটবার মানুষ সবথেকে ফ্রেন্ডলি। তাই মনে হয় প্রভিন্সের নামের সাথে ট্যাগ করা হয়েছে ফ্রেন্ডলি ম্যানিটবা। গাড়ি থামিয়ে কতজনই না জিগ্গেস করেছে আমাদের অবস্থা কি? অতি সাধারন কথার মধ্যেও আন্তরিকতার বিশালতা অনুভব করা যেত সহজেই।

উইনিপেগ থেকে আমরা কেনরা হয়ে থানডার বে’ তে যাব। এটাই ওন্টারিও, আর টরেন্টো এই প্রভিন্সেই। ম্যনিটবার সর্বশেষ যে ছোট্ট যে শহরে ছিলাম একবাতের জন্য তার নাম ছিল রেনি। একটা মোটেল, গ্যাস স্টেশন, ছোট্ট একটা মুদি দোকান। আমরা পৌছানর আগেই মুদি দোকান বন্ধ হয়েগিয়েছিল। এখন মনে মনে ভাবতে ভালই লাগে, অনেক ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও ট্রেপারদের মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলাম রাতের বেলাতেই। যদিও সবাই বলছিল একটা দিন থেকে যেতে।

ওন্টারিওতে ঢুকারপর ফিলিংটা জানি কেমন ছিল। ম্যনিটবার সরু হাইওয়ে থেকে হঠাৎ করে চারলেনের বড় রাস্তাটা যেমন স্বাভাবিকতাকে আহত করে, তেমনি কেমন জানি একটা অনুভুতি হলো এই প্রভিন্স নিয়ে! সেই অনুভুতিটা যে আসলেও যে কতটুকু সত্য তা এখন আরো ভাল করে বুঝতে পারি। আমার কাছে ওন্টারিও কানাডা বাকি প্রভিন্স গুলোর মধ্যে সব থেকে কম বন্ধুবৎসল। হতে পারে এখানে বড় শহরের সংখ্যা বেশি আর শহর কেন্দ্রিক মানুষের মানষীকতা মনে হয় একটা অন্য রকম।

তাই থানডার বে তে আসার পর বাক্সপেটরা আবার ভাল করে ঠিকঠাক করে নিলাম। লেক সুপিরিয়রের কোলেই আমাদের বাকি দিন গুলোর বেশির ভাগ কাটাতে হবে। লেক সুপিরিয়র দুনিয়ার সব থেকে বড় মিঠা পানির হ্রদ। বিশালতার আরেক নাম মনে হয় লেক সুপিরিয়র! প্রায় ১৪শ কিলোমিটারের পথ তখনও বাকি টরেন্টো অব্দি। এর মাঝে আমার হাটুর সমস্যা প্রায় শেষ হয়ে গেছে তবে নতুন যেটা হলো তা আমার ডান পায়ের সীন বোনে। শেষের সপ্তাহ গুলোতে আমরা অনেক বেশি চালিয়ে ছিলাম মনে হয়। তাই পা’কে দোষ দিয়ে আর কি লাভ? ম্যানিটুলান আইল্যান্ড ক্রস করে যখন টবলমুরিতে আসলাম, আমার পা আর চলতে চাইলনা। এটা মনে হয় ঠিক জীবনের মতই – চলতে চলতে থেমে যাবে একদিন।

রেস্ট ডে। পায়ের যতœ নেয়া হলো, দেয়া হলো সময় সেরে ওঠার জন্য। পরের দিন আবার রওনা হলাম। টরেন্টো আর মাত্র ১৫০ কিলোমিটারের মত। হয়ে যাবে এক বা দুই দিনে। কিন্তু না। মার্কডেল পর্যন্ত আসতে পারলাম। আর হলো না! পায়ের ব্যাথাটা অনেক বেরে গিয়েছিল। আর ১০০ কাল বা পরশু হয়ে যাবে।

রেস্ট নিলাম, কিন্তু কাজ হলো না। একদিন, দুই দিন, নাহ হলোই না আর। ব্যথাই যেন কমে না আমার সীন স্পিল্ট এর। তাই বন্ধুর দারস্থ হতে হলো। চলে এলাম টরেন্টোতে। আমাদের গত ৯২ দিনের রাইড আর ২ বছরের পরিকল্পনা শেষ হলো মার্কডেলের একটা মোটেলে।

আফসোস বলতে যেটা সেটা হলো টরেন্টোতে সাইকেলে আসা হলো না। পূর্ব পরিকল্পনা মতে সাত হাজার কিলোমিটারের রাইড হলেও আমরা করেছি ৬ হাজারের কাছাকাছি। বাকি পথ গুলোর মধ্যে বিশাল একটা পথ ট্রেনে করে আসতে হয়েছিল কনক ভাই দেশে চলে যাবেন বলে। আর বাকিটা কখনও বা সাইকেলের জন্য বা শারীরীক অপারগতার জন্য।

তো আমার গল্পের শেষটা এমনই। তবে কিছু কথা এখানে বলে রাখা ভাল। এমন একটা ট্রিপ থেকে কি পেলাম বা কি পাওয়া যাইতো এমন ইকুয়েসন করাটা খুব বেশি বুদ্ধিমানের কাজ কিনা জানি। আমি কি পেলাম আর আমি কেন করি সেটা নিজের কাছে পরিস্কার থাকা দরকার। সাথে এটাও মনে রাখতে হয় যে আপনি এমন একটা রাইড দেয়ার পর পৃথিবীর কোন কিছুই আমলে বদলে যাবে না আপনার জন্য। কিন্তু আপনি অনেকে মানুষকে কষ্ট দিবেন – আপনার প্রিয় পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে সহকর্মী এবং বসকেও।

কি লাভ? সে হিসাবের নামটাই মনে হয় প্রাইস অব ফ্রিডম। ফ্রিডম কখনই ফ্রি না। তাই প্রতিবারের মতো আমার এই ফ্রিডমের মূল্য তালিকায় পূর্বের সব খরচার সাথে যুক্ত হয়েছিল অনেক নতুন কিছু। তবে আমার মনে হয় সেই পাওয়াটা বিশাল যখন সিডর ব্যাপিডস এর কাস্টম অফিসার আর চোখে দেখে ছিল আমার সাইকেলে লাগানো বাংলাদেশের পতাকা। সে প্রাপ্তির মূল্য দেয়াটা মনে হয় সম্বব হবে না আমি আইসফিল্ড পার্কওয়েতে লাল-সবুজের পতাকাটা নিয়ে যখন বিশাল চড়াই টাকে ট্যাকেল করছিলাম। একেতো ছোটচাকার ট্যানডেম তার উপর ” আ লিটল ব্রাউনম্যান উইথ রেড গৃন ফ্লাগ” মনে হয় একটু বেশিই ছিল।

গল্পের শেষে এটাই বলা যায়, আবার কবে কোথায় যাব, কিভাবে যাব জানি না। বাস্তব জীবনের চাকায় আমাকে আবার চলতে হবে। এরই নাম মনে হয় জীবন। প্রতিবার ট্রিপের জন্য যেমন চাকরি খোতে হয় বা বন্ধু বৎসল বসের সাথে সম্বপর্ক খারাপ করতে হয় তেমনি বাবা-মাও মনে হয় অনেক কষ্ট পায়।

আমাদের ফ্রিডমের প্রাইসটা আমাদেরই দিতে হয়। তবে নিজের স্বার্থপরতার সাথে যখন দেশ চলে আসে, চলে আসে ক্ষুদ্র একটা ভাললাগা – আমি ক্ষুদ্র হলেও দেশ বা দশের জন্য আমার জায়গা থেকে কিছুটা করতে পারি। কতটুকু পারলাম তার পরিমাপের মাপকাঠি আমার কাছে। কোন লজ্জা নেই, ভয় নেই। এটা একটা অদ্ভুত ভাললাগা। ঠিক বুকের মধ্যে দলা পাকানো বাতাসের মত – তবে এটার পরিমিতি মনে হয় দুঃখের থেকে বেশি আনন্দের।

তাই দি প্রাইস অব মাই ফ্রিডম যতই হোক আমার দিতে খারাপ লাগে না আর।

Leave a Reply