প্যারিস চুক্তি: কেউ কথা রাখেনি
চুক্তি সম্পন্নের এক যুগের কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই চুক্তি মোতাবেক কাজ করছি না আমরা। কপ-২৮ সম্মেলনে আইপিসিসির চেয়ারম্যান বলেছেন, যদি আমরা অচিরেই অতিমাত্রায় নিঃসরণ ঠেকাতে বা কমাতে না পারি তাহলে এই চুক্তির উদ্দেশ্যে অর্জিত হবে না।
Published : 10 Jun 2024, 03:49 PM | Updated : 10 Jun 2024, 03:53 PM
On bdnews24.com
গত বছরের গরমের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে— গরম একটু বেশি ছিল। এই একটু বেশির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছে নাসা। গত বছরের জুলাই মাসে যে গরম পড়েছে তা ১৮৮০ সাল থেকে আজ অবধি যে কোনো মাসের মধ্যে সব চেয়ে গরম বা উষ্ণতম। গত অগাস্টে তাদের এক প্রকাশনায় বিষয়টি প্রকাশ করে তারা।
এত গরম তো পড়ার কথা ছিল না, যদি সবাই তাদের কথা রাখত। কেননা ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে যে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস (কপ-২১) হয়েছিল তাতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘে এক আর্ন্তজাতিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। যা প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট বা প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাকর্ড নামে পরিচিত। জাতিসংঘের ১৯৬টি দেশ এতে সম্মতি দিয়েছিল। ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসি) গঠিত হবার ২৪ বছর পর এই সম্মতিতে আসতে পেরেছিল জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো। এই সম্মতির উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
দুই যুগ সময় লেগেছিল শুধুমাত্র এটা স্বীকার করে নিতে যে, আমাদের কৃতকর্মের জন্য জলবায়ু পরিবর্তিত হয়। আর এর কারণে বাড়ে অতি বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে করে আমরা একটা ধারণা করতে পারি যে, প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট হবার আগে আমরা স্বীকারই করতে চাইনি যে জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা নিজেরাই দায়ী।
প্যারিস চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে নাগালের মধ্যে রাখা। যেহেতু পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে তাই যদি আমরা তাপমাত্রাকে নাগালের মধ্যে রাখতে পারি তবে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো যাবে। লক্ষ নির্ধারণ করা হয়, বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা শিল্প বিপ্লবের (হিসেবের সুবিধার্থে ১৮৫০-১৯০০ সাল) আগে যা ছিল তার থেকে বেড়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক যেন না হয়। জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে বৃদ্ধিটা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার।
সংখ্যাটি দেড় ডিগ্রি হবার পেছনেও অনেক কারণ আছে। মূল কারণ হিসেবে বলা হয়, এটাই সব থেকে সহিষ্ণু মাত্রা, যে তাপমাত্রায় পৃথিবীর বেশিরভাগ অঞ্চলের পরিবেশগত পরিবর্তন কম হবে বা হতে পারে। কথা ছিল এই তাপমাত্রার লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে সহায়তা করবে। আবার প্রতিটি দেশ তাদের জাতীয় জলবায়ু অ্যাকশন প্ল্যান কেন্দ্রীয়ভাবে জমা দেবে। যাকে বলা হয় ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি)। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর প্রতিবেদন জমা দেবে রাষ্ট্রগুলো। এই সময় একটি দেশ কি পরিমাণ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমালো তাও উঠে আসবে ওই প্রতিবেদনে।
রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণেই হোক বৈশ্বিক বা সামষ্টিকভাবে একাত্ম হতেই যেখানে দেশগুলোর দুই যুগ লেগে গেছে তাই এনডিসি-এর কার্যকারিতা কতটা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কেননা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাকে কমানোর বা ধরে রাখার জন্যে যে পরিমাণ রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বোঝাপড়ার দরকার ছিল বা আছে তাতে আমরা পিছিয়ে ছিলাম শুরু থেকেই। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১.৫ এবং ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ধরে রাখার জন্যে যা প্রয়োজন, তার ধারে কাছেও নেই আমরা।
আমরা এটা জানি যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণের সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক আছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি বা কমলে তাপমাত্রাও বাড়ে আর কমে। সরল করে এভাবেই বলা যায়। এনডিসি-এর লক্ষ্যমাত্রা ১.৫ এবং ২-এর মধ্যে রাখতে হলে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ ১৫ গিগাটন এবং ৩২ গিগাটন (GtCO2e) হতে হবে। ১ গিগাটন হলো ১ বিলিয়ন মেট্রিক টন। শুধু ২০২৩ সালের মোট নিঃসরণ হলো ৩৭.৫ গিগাটন। এর মানে হলো যদি আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই তবে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টার প্রায় তিন এবং পাঁচ গুণ বেশি কাজ করতে হবে।
চুক্তি সম্পন্নের এক যুগের কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই চুক্তি মোতাবেক কাজ করছি না আমরা। যা সরাসরি প্যারিস চুক্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাই দুবাইয়ের কপ-২৮ এ আইপিসিসির চেয়ারম্যান বলেছেন, যদি আমরা অচিরেই অতিমাত্রার নিঃসরণ ঠেকাতে বা কমাতে না পারি তাহলে এই চুক্তির যে উদ্দেশ্যে তা অর্জিত হবে না। ২০২৩ সালের মধ্যেই আমরা পৃথিবীকে ৩ ডিগ্রি বেশি উষ্ণ করে ফেলেছি।
এখন কি আমরা ধরতে পারছি, ২০২৩ সালের গরমকাল কেন এত গরম ছিল! চুক্তি মোতাবেক হবার কথা ছিল উল্টো। মানে আমাদের নিঃসরণ হবার কথা কম। কিন্তু হয়েছে বেশি। এখানে আবার একটা কথা না বললেই নয়। যে চুক্তিতে আসতে আমাদের ২৪ বছর লেগেছে, তাতেই ধরে নেয়া যায় বা যেতে পারে যে সকল দেশের অংশগ্রহণের একাগ্রতা সমমানের হবে না।
মজার ব্যাপার হলো, আমরা যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলি, সকল রাষ্ট্রের সমন্বিত অংশগ্রহণের কথা বলি, তাতে আমরা ঠিক কি বোঝাতে বা বুঝতে চাই— সেই প্রশ্ন রেখে যাওয়া যেতে পারে। কেননা গরম পড়বে, শীত আসবে, শরৎ আসবে। ঋতুর পরিবর্তন ঘটবে। এটাই চিরায়ত সত্য। এর ব্যত্যয় হবে না। কিন্তু এই শীত ও গরমের মাঝে ও পরের যে সময় ওই সময়ের ব্যাপ্তির তারতম্যের পার্থক্যকে আমরা সাধারণভাবে ধরতে পারি। এটাও ধরতে পারি, গরম বাড়ছে না কমছে, শীত তীব্রতর হচ্ছে নাকি ঠিক আগের মতো হচ্ছে না। এই আগের মতো আর বর্তমানের যে তারতম্য সেটা যে আমাদের সামষ্টিক উন্নয়ন, নগরায়ন, পুঁজিবাদ এবং বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতির যোগফল তা ঘটা করে কেউ না বললেও মোটা দাগে এরাই দায়ী তা বলা যেতে পারে।
এখানে যাদের কথা রাখার কথা ছিল— বিশ্ব অর্থনীতির যুবা, বৃদ্ধ, মোড়ল, প্রজাগণের, তারা কেউ কথা রাখেনি। রাখছে না। রাখবেও না। রাখবেও না বলা যেতেই পারে। এর জন্যে নস্ট্রাডামুস হবার দরকার পড়ে না। যে হারে যুদ্ধ আর বাণিজ্য নিয়ে দাপাদাপি, তাতে এই সমীকরণের ফলাফল আমরা নিজেরাই বের করতে পারি। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধের কার্বন ফুটপ্রিন্ট নিয়ে কেউ কথা বলেন না। কেন? যারা বা যেসব দেশ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের ডামাডোলের অধিকর্তা, তারাই কিন্তু এই সূচকের ঘটক। তারা যদি নিজেরাই তাদের তৈরি সূচকের মান ধরে রাখতে না চায়, তবে আমাদের মতো আম-আদমের আর কী করার আছে? এখানে নিজেদের দায়িত্ব থেকে অপার মুক্তির যে ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকে যায় যা বিপ্রতীপভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে অনুঘটকের কাজ করবে বা করে আসছে। তাই নিজেদের অবদানকে টালি খাতায় রাখতে হবে। ব্যাপারটা ঘোরেল— ডিম আগে না মুরগি আগে প্যারাডক্সের মতো। যে যেভাবে তার উত্তর বের করতে চায়!
গত বছরের গরমের তেজ এই বছরের কাছে কিছু নয়। এটা ঢাকাবাসী, কলকাতাবাসী, দিল্লিবাসী সকলেই একমত হবে। এই তিন শহরের সাথে পৃথিবীর শত শত শহরের নাম উঠে আসবে যদি খুঁজতে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে ঝড় এল, এমন সময়ে, যার আগে ভয়াবহ দাবদাহে সারাদেশের অবস্থা ত্রাহিত্রাহি। বৃষ্টির জন্য দোয়া, মানত, কাফফারার এন্তেজামে কাতর আপামর আমআদমি। সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি এল ভীষণ ঝড় হয়ে। দিয়ে গেল দগদগে ঘা। এই ক্ষতের জন্য আমরা নিজেরাই কি দায়ী নই? প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশ, মহাদেশের সম্মিলিত গাফিলতিতে ভেসেছে আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিম, তৈরি হয়েছে মরুভূমিতে বন্যা। সবই দেখা হলো এ বছরের আধাআধিতে। এখনও অর্ধেকটা তো বাকিই রয়ে গেছে।
অপেক্ষা করি আর উচ্চস্বরে পরিবেশ দিবসের গান গাই।