মাইক্রোপ্লাস্টিক, ‘সিঙ্গেল-ইউজ’ প্লাস্টিক এবং আমাদের দায়
দরিদ্রদের কাছে পণ্য বেঁচতে ‘স্যাসে কালচার’ বা ‘মিনি প্যাক’ শুরু হলেও, এখন সব শ্রেণির মানুষই এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, যা ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়িয়েছে।
ব্রিটেনের বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হারপারকলিন্স পাবলিকেশন-এর কলিন্স ডিকশনারির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। আগে তাদের পুস্তক আকারে মুদ্রিত অভিধানটি অনেকের বাসায় থাকতো। এখন হয়তো, অনলাইনেই অভিধানটি আছে বলে, ডিকশনারি রাখার চলটি কমেও গেছে।
সে যাই হোক কলিন্স ডিকশনারির কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর একটি শব্দকে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে নির্বাচিত করে। একটি নির্দিষ্ট বছরে সারা পৃথিবীতে কোন শব্দটির তাৎপর্য সবচেয়ে বেশি থাকে বা কোন শব্দটি সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে এই প্রতিযোগিতার ফলাফল দেওয়া হয় (প্রকৃত প্রক্রিয়াকে সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে)। ২০১৮ সালে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হয়েছিল ‘সিঙ্গেল-ইউজ’ শব্দটি। যদিওবা ‘সিঙ্গেল’ এবং ‘ইউজ’- এ দুই শব্দের ব্যবহার একেবারেই ভিন্ন, কিন্তু একসাথে জুড়ে গিয়ে ভিন্নার্থ তৈরি হয়। নতুন শব্দটি পুনঃব্যবহার অযোগ্য বা একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়, এমন পণ্যের প্রতি আসক্তির কথা বলে। [১]
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ক্রয় কিংবা ব্যবহারকৃত জিনিসপত্রের মধ্যে মাত্র একবার ব্যবহার করা যায় এমন পণ্যের আমরা প্রায় আসক্ত হয়ে পড়েছি। এখানে হয়তো ‘আসক্ত’ শব্দটি কানে লাগতে পারে, কিন্তু বাস্তবতাই এমন যে আমরা ‘সিঙ্গেল-ইউজ’ পণ্য ক্রয় কিংবা ব্যবহার থেকে আমরা বিরত থাকতে পারছি না। সেটা পরিস্থিতি বা সুবিধা- যে কারণেই হোক না কেন।
এই ‘একবার মাত্র ব্যবহার্য’ (যার প্রায় সবটাই প্লাস্টিকে তৈরি), যাকে ‘সিঙ্গেল-ইউজ’ (প্লাস্টিক) বলে, সে ধরনের পণ্য এবং আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামগ্রিক পরিবেশকে মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নেওয়ায় এসব পণ্যের ভূমিকা নিয়েই মূলত এ নিবন্ধ।
কী এই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক?
প্লাস্টিক বেশিরভাগ সময়ই ‘সিঙ্গেল-ইউজ’ নয়। অর্থাৎ, একবার প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার শেষ হলে সংরক্ষণের পর রিসাইকেল করা গেলে, ব্যবহৃত পণ্য থেকে একই প্লাস্টিক পণ্য বা আরেক ধরনের পণ্য তৈরি সম্ভব। তাই প্লাস্টিককে ‘সিঙ্গেল-ইউজ’ তখনই বলা হয়, যখন আর এটি পুনরায় অন্য পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের অবস্থাতেও থাকে না। পুনরায় ব্যবহারযোগ্যতা না থাকার অনেকগুলো কারণের একটি হচ্ছে, ব্যবহারের পর কোনও প্লাস্টিক পণ্যকে রিসাইকেলের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা।
আবার, একের অধিক পদার্থ (পলিমার) দিয়ে তৈরি করা কোনও প্লাস্টিক পণ্যের বর্জ্য থেকেও একই জাতীয় বা নতুন ধরনের পণ্য তৈরি করা কঠিন, ব্যয়সাপেক্ষ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে একেবারেই অসম্ভব। মূলত প্লাস্টিক পণ্যটি একবার ব্যবহারের জন্যই তৈরি- সেটাকেই ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিক বলা যেতে পারে।
‘সিঙ্গেল-ইউজ’ প্লাস্টিক পণ্যগুলো ব্যবহারের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরাসরি জমিতে এবং নদী-নালা-খাল-বিল-সাগর-মহাসাগরে জমা হয়। বলা হয়, ‘সিঙ্গেল ইউজ’ মোট উৎপাদিত ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিক পণ্যের প্রায় ৭০ ভাগই এভাবে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। মাইক্রো, মেসো, ম্যক্রো ডেবরি হিসেবে (যা ‘মেরিন ডেবরি’ নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে) পরিচিতি এসব প্লাস্টিকের অন্তিম গন্তব্য হলো সাগর-মহাসাগর। [২]
ইউরোপিয়ান কমিশন ১০ ধরনের ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিক পণ্যের একটি তালিকা করেছে। সেগুলো হলো-
– কটনবাড স্টিক (আমরা কান পরিস্কার করার জন্য যে ‘কটন বাড’ ব্যবহার করি)
– প্লাস্টিকের ছুরি, চামচ, প্লেট, গ্লাস, স্টারার (যেমন কফি নাড়ার জন্য যে ছোট স্টিক/কাঠি)
– বেলুন এবং এর সাথে যে/যদি কোন কাঠি থাকে
– খাবারের মোড়ক (কন্টেইনার বা প্যাকেট)
– তরলপানীয় পানের জন্য কাপ
– তরলপানীয়র কন্টেইনার
– প্লাস্টিকের ব্যাগ
– মোড়ক/ প্যাকেট
– স্যানিটারি আইটেম
ইউরোপিয়ান কমিশনের এ তালিকাটি আসলে বৈশ্বিক। কটনবাড একবার ব্যবহার করে আমরাও ফেলে দেই। এখন অনেকেই বলতে পারেন কতজন এই কটনবাড বাংলাদেশে ব্যবহার করেন। সে পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই, তবে ফুটপাথের দোকানে একে অহরহ দেখা যায়। মূল্যও নামমাত্র। তালিকার বাকি পণ্যগুলোও আমাদের এখানে বহুল ব্যবহৃত।
আমরা আগেই জেনেছি, কোনও একটি প্লাস্টিকে তৈরি পণ্য ব্যবহারের পরে ফেলে দেওয়া হলে এবং ফেলে দেওয়া সে পণ্যটিকে রিসাইকেল করা না হলে, সময়ের সাথে সাথে তাপ, বায়ু প্রবাহ, জলীয়বাষ্পসহ নানানবিধ প্রকৃতিক অনুঘটকের ক্রিয়ার কারণে সেসব পণ্য ভেঙে যেতে থাকবে। এসব পণ্য ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা আকার ধারণ করে যা বেশিরভাগ সময়ে আর খালি চোখে দেখা যায় না। একেই বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। যেহেতু এটি কোনও না কোনও ধরনের প্লাস্টিক পলিমারে তৈরি তাই ভেঙে ছোট হয়ে যাবার পরেও সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে প্লাস্টিকের সব ধরনের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। এ ধরনের প্লাস্টিকের কণা পরিবেশের সাথে যুক্ত হতে থাকে। মাটি-পানি-বায়ু সবখানে।
‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিক পণ্যগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরিতে কাঁচামাল বিশাল নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এর মূল কারণগুলো আমরা নিজেরাই বের করতে পারি। বাজার থেকে খাবার কেনা ভাত-বিরিয়ানি কিংবা গ্রিলড চিকেন- যে মোড়কে দেওয়া হয় সেটি কি আমরা আবার ব্যবহার করি? নাকি করতে পারি?
মোড়কটি যদি শক্ত প্লাস্টিকে তৈরি হয় তবে হয়তো বা কেউ কেউ আবার ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু যদি স্টারোফোমে (কর্কশিট নামে বহুল পরিচিত খুব হালকা, সাদা রংয়ের বস্তু যা একটু এদিক ওদিক হলেই ভেঙ্গে যায়) তৈরি হয় তবে তা পুনঃব্যবহারের অনুপযোগী। আবার কতকগুলো অন্যান্য প্লাস্টিকেও তৈরি হয়। এটি সেই জিনিস আমরা হাটে-মাঠে-ঘাটে খাবার পর ফেলে দিই। এসব বর্জ্য দেখা যাবে না এমন জায়গা বাংলাদেশে বিরল। এসব ‘সিঙ্গেল-ইউজ’ পণ্য বা মোড়ক যেমন পুনঃব্যবহারের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়নি, তেমনি একবার ব্যবহার করে তাকে সংগ্রহ করে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় নিয়ে আনাটাও ব্যয়বহুল। তাই এর অন্তিম গন্তব্য হয় আমাদের চারপাশ-নদীনালা। প্লাস্টিক ভঙ্গুর। তাই কালাতিক্রমে এটাও মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। পানিতে পাওয়া যেকোন ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিককে ‘মাইক্রোডেবরি’ও বলা হয়। [৩]
এভাবে এগোতে থাকলে ইউরোপিয়ান কমিশনের তালিকায় স্থান পাওয়া প্রতিটি পণ্য একবার ব্যবহৃত হবার পর কী কী হয় সেটা আমরা হয়তো নিজেরাই অনুমান করতে পারছি। প্রশ্ন আসতেই পারে এখানে আমাদের কী করার আছে? জটিলতা ঠিক এখানেই। আমাদের অভ্যাস এখানে বড় একটা নিয়ামক। কীভাবে?
স্যাসে (Sachet) শব্দটি আমাদের দেশে একটু কম পরিচিত। কিন্তু যদি ‘মিনিপ্যাক’ বলা হয়, তবে সদ্য কথা বলতে থাকা শিশুও ধরে ফেলতে পারবে- কী সেটা। এই সত্যকে অস্বীকার করার মতো আছেন কি কেউ? মিনিপ্যাক বা স্যাসে একদমই পুরোনো নয়। খোলা বাজারে স্যাসে বা মিনিপ্যাকের প্রচলন সবার আগে বেশি মাত্রায় শুরু হয় ভারতে [৪]। দেশটির বিশাল জনগোষ্ঠির বাজার ধরতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। ‘মিনিপ্যাক’ পণ্য বাজারে আসার আগে কোন পণ্য (ধরা যাক শ্যাম্পু) কিনতে হলে একটা নির্দিষ্ট আকারের কন্টেইনারই কেবল ছিল। শক্ত (হার্ড) প্লাস্টিকে তৈরি এই কন্টেইনারগুলোতে পণ্যের দাম বেশিরভাগ জনগোষ্টির ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কীভাবে একই পণ্য বিক্রি করা যায়, সেই বাজার কৌশল থেকেই এ ‘স্যাসে কালচার’ বা ‘স্যাসে ইকোনমি’র জন্ম।
‘স্যাসে ইকোনমি’ বলতে মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য বিশেষভাবে এবং অতি অল্প খরচে (সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক) মোড়কজাত নিত্য ব্যবহারযোগ্য যেমন– কাপড় কাঁচার গুঁড়া সাবান, শ্যাম্পু, গুঁড়ো দুধ, মশলা ইত্যাদি পণ্যের (ফাস্ট মুভিং কনজুমার গুডস/ এফএমসিজি) অর্থনীতিকে বোঝায়। পণ্য উৎপাদন, বিপণন এবং এর গ্রহণযোগ্যতায় পণ্যের মোড়ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোড়কের খরচের ওপর পণ্যের খুচরা মূল্যের দামের তারতম্য হয়। দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত- এই বিশাল জনগোষ্ঠির তালিকায় নিজেদের পণ্যে গুজে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতকারীরা যতটা সম্ভব কম দামের মোড়ক পণ্যের জন্য ব্যবহার করতে চায়। [৫]
আর এ কারণেই মিনিপ্যাক বা স্যাসেগুলোকে প্লাস্টিকের (ম্যাটেরিয়াল ক্লাসিফিকেশনে না গিয়ে অতি সাধারণভাবে বলা হচ্ছে) হতে দেখি, যা আদতেই রিসাইকেল এর উপযোগী নয় বা করা গেলেও ব্যয়-সাপেক্ষ।
আমাদের প্রতিদিনের ক্রয়তালিকা থেকে নিজেরাই বলতে পারি কতগুলো পণ্য এই মিনিপ্যাক বা ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিকে মোড়কজাত। এর পাশাপাশি লক্ষ্য করলে দেখবো, ব্যাগ হাতে বাজারে যাওয়ার রীতি বা অভ্যাসও আমাদের উবে গেছে। বেশিদিন আগের কথা নয়, বাজারের জন্য একটি ব্যাগ নিয়েই আমরা বাসা থেকে বের হতাম। এর থেকে কীভাবে সরে আসলাম সেটির উত্তর জানা নেই।
এখন যেকোনও পণ্য কেনার সাথে সাথেই একটি একটা পলিব্যাগ ধরিয়ে দিচ্ছেন দোকানিরা। কাগজের ঠোঙার চল উঠে যায় যায়। এক বাক্স মশার কয়েল কিনলেও একটা পলিব্যাগে দেওয়া হয়। আবার আমরাও সেটা গ্রহণ করি এবং কখনো কখনো চেয়েও নিই। এখানে দোষটা যে কার সেটা বের করা কঠিন! দায়ভার কাকে দেওয়া যায় সেই সমীকরণের উত্তর পাবার আগেই, এই বাড়তি পলিব্যাগের পারিপার্শ্বিক নেতিবাচক প্রভাবের সাথে আমরা এতদিনে পরিচিত হয়ে গিয়েছি।
ঢাকার রাস্তায় জলাবদ্ধতার খবর নতুন নয়। পরিসংখ্যান বলছে, মোট বিক্রিত এই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের মোড়কের প্রায় ৮০ শতাংশ যত্রতত্র ফেলা হয়। যা শেষ পর্যন্ত নগরের পয়ঃনিস্কাশন প্রণালীতে (ড্রেনেজ সিসটেম) গিয়ে জমা হয়। আর যে কারণে বৃষ্টির পানি সময়মত সেই প্রণালী দিয়ে যেতে পারে না [৬]।
প্লাস্টিক যে একটি সমস্যা এটা বোঝাপড়ার শুরু মাত্র সিকি শতাব্দী হলো। প্লাস্টিকের উৎপাদন মাত্রার এই উর্ধ্বগতি আমাদের জীবদ্দশাতেই। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৮ হাজার ৩০০ মিলিয়ন টন ভার্জিন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করেছে। যার মাত্র ৯ ভাগ রিসাইকেল করা গেছে। আর ১২ ভাগ পুড়িয়ে (incinerate) এবং বাকি ৭৯ ভাগ প্রাকৃতিক পরিবেশে/ ভূমিতে (ল্যান্ডফিল) রয়ে গেছে। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ১২ হাজার মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভূমিতে (ল্যান্ডফিল) জমা হবে, যার বেশিরভাগই মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হবে [৭]। এই পরিসংখ্যানের তরজমা আমরা ঢের বুঝতে পারি। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকে নগর জীবনের দুর্বিষহতার মাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে তা বর্ষাকাল এলেই অন্তত বোঝা যায়।
পণ্য কোনও না কোনওভাবে প্লাস্টিকের মোড়কটি ছিঁড়ে-কেটে বের করতে হয়। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, এই যে একটা প্যাকেট আমরা খুলছি বা কেটে ফেলছি কিংবা যেকোনওভাবে ভিতরের পণ্যটিকে বের করে আনছি, এ প্রক্রিয়াতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়? খানিকটা খটকা লাগলেও সত্যটা হলো যেকোন কঠিন বস্তুকে (যেমন প্লাস্টিকের প্যাকেট) যদি টুকরো করা হয় (এখানে মোড়ক উন্মোচন/ কেটে/ ছিঁড়ে খোলা) তা থেকে সেই কঠিন বস্তুর কিছু কণা হলেও পরিবেশের সঙ্গে মিশবে। এর মানে হলো, কাঁচি-ছুরি ব্যবহার করে বা টেনে কিংবা দাঁত দিয়ে যদি কোনও প্লাস্টিকের মোড়ক খুলি, তাতেও নির্দিষ্ট পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক ঝরে পড়বে [৮]।
আমরা স্বভাবজনিতভাবে দাঁত দিয়ে চকলেট, বিস্কুট, চিপস ইত্যাদির প্যাকেট খুলে থাকি। এক্ষেত্রে ছেঁড়ার সময় যে পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক ঝরবে তার একটা অংশ বায়ুবাহিত হয়ে নাক দিয়ে, আরেকটা অংশ পানিবাহিত হয়ে মুখ দিয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশের আশঙ্কা থাকেই। ভয়াবহতা এখানেই, মাইক্রোপ্লাস্টিক ঠিক কীভাবে আমাদের দেহে ক্রিয়া করে বা করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। মানুষের মলে মাইক্রো-প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। [৯]
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা ১৫ জন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের দেহে বছরে আনুমানিক ৭৪ হাজার থেকে ১ লাখ ২১ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা প্রবেশ করতে পারে খাদ্যগ্রহণ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে মাধ্যমে। [১০]
এ জাতীয় পরিসংখ্যানে আমরা কিছুটা অভ্যস্ত ইদানিং। একথাগুলো বলার কারণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে ক্রয়যোগ্য পণ্যের পরিমাণ বেড়ে যেমন গেছে, তেমনি আমাদের দায়িত্বশীলতায় শিথিলতাও বেড়েছে। লক্ষ্য করে দেখবেন নিম্ন আয়ের মানুষের বাজার ধরার জন্য যে স্যাসে কালচার তৈরি হয়েছিল, তা এখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্রয় সংস্কৃতির মধ্যেই ঢুকে গেছে।
বাড়িতে দাওয়াত দিলেও ওয়ানটাইম ইউজ প্লেট-গ্লাসের ছড়াছড়ি। কিন্তু শোকেস ভর্তি কাঁচের বাসন। এই চিত্র কী অচেনা? বাজার করতে যাওয়া হয়, কিন্তু একটা ব্যাগ আমরা সঙ্গে নিতে পারি না। এখন অনেকেই হয়তো বলবেন, কাজ থেকে সরাসরি বাজারে যাওয়া হয়! কিন্তু এটা কি শতভাগ সত্য যে চাইলেও পলিথিনের ব্যাগকে আমরা ‘না’ বলতে পারি না? পলিথিনকে দোষ দেওয়ার আগে আমরা এটাকে কিভাবে ব্যবহার করছি, সেটা দেখা ভালো।
একদিনে সব বদলাবে না। যেমন একদিনে আমরা পলিথিনে ডুবিনি। আইনও করা হয়েছে। পলিথিন ব্যাগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় সেই নিষিদ্ধ করার নজির? আইনের জটিল আবর্তে যাওয়া যায়, তবে সমস্যা সমাধানে ব্যক্তির সদিচ্ছাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ এর উদাহরণ দিয়ে শেষ করতে চাই। গণিতবিদ ও আবহাওয়া বিজ্ঞানী অ্যাডওয়ার্ড লরেঞ্জ একটি প্রশ্ন দিয়ে ‘বাটারফ্লাই ইফেক্টে’র জন্ম দিয়েছিলেন। তার প্রশ্নটি ছিল খুব কাব্যিক- “ব্রাজিলে কোন প্রজাপতির ডানার ঝাপটানিতে টেকসাসে ঝড় হবে কি?”
[১২]। আসলে বাটারফ্লাই ইফেক্ট তত্ত্বের মূল কথা ছিল- “A very small change in initial conditions had created a significantly different outcome.” [11]
‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ অগ্রাহ্য করার কোনও উপায় নেই। এর ওপর ভিত্তি করেই আজ আবহাওয়ার আগাম বার্তা দেওয়া সম্ভব হয়। সূচনা যতই ছোট হোক, যদি ঠিকঠাক শুরু করা যায়, এর শেষটা যে বড় কিছু হবে না, সেটা বলা যায় না।
তেমনি মাইক্রোপ্লাস্টিক কম উৎপাদনের চেষ্টা ছোট করে হলেও আমাদের শুরু করা উচিত। শুরু হোক তবে! উত্তর চলে আসবে আপনা থেকেই।