দুচাকায় আলাস্কা থেকে টরেন্টো


আর দশ বছর পর পৃথিবীর অবস্থা কি হবে? জলবায়ুর পরিস্তিতি কি দাড়াবে? যদি দশ বছরটাকে আরো বাড়িয়ে ধরা হয়তো? ধরুন ১০০ বছর? তখনও কি আমরা আমাদের দেশের যে ভৌগলিক সীমা রেখায় আছি, তাই কি থাকবে?

এমন অবস্থার কি উত্তর হবে সেটা মনে হয় আমাদের কারই জানা নেই। আর একারনেই মনে হয় ক্লাইমেট চেঞ্জ বর্তমান দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ গুলোর মধ্যে অন্যতম। ক্লাইমেট চেঞ্জে আমাদের পরিনতি অন্য দেশগুলোর থেকে অনেক বেশি করুন হবে এটা আর নতুন করে আবিস্কারের কিছু নয়। তবে আমরা, আম জনতা হিসেবে এর প্রতিকার কিভাবে করতে পারি তার জন্যই আমরা তিন বন্ধু সাইকেলে একটা প্রচারনা অভিযান করার পরিক্লপনা করি অনেক আগে।

পরিসঙখানে দেখা যায়, পৃথিবীতে শিল্পন্নত দেশ গুলোর কলকারখানা থেকে শুরু করে তাদের নিত্য নৈমতিক জীবন যাপনে কার্বনের নিঃসরন হয় সবথেকে বেশি। পরিবহন, বাসস্থলী থেকে শুরু করে খাদ্যাব্ভাস, সব কিছুইতে প্লাস্টিক জাতীয় পন্যের বিপুল ব্যবহার এই কার্বন নিঃসরনকে বাড়িয়ে দেয়।

আর প্লাস্টিকের তৈরি যে কোন পন্যের তৈরিতে যেমন কার্বনের নিঃসরন হয় তেমনি আর্বজনা হিসেবেও এটা পরিবেশের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। তাই বিশ্বব্যপী প্লাস্টিকের এই অধিক ব্যবহারের ফলে ক্লাইমেটের যে পরিবর্তন আসছে তাতে আমাদের মত দেশগুলোর জন্য ভয়াবহ।

মানুষ যাতে প্লাস্টিকে তৈরি পন্যের ব্যবহার কম করে তার জন্য আমাদের এই অভিযান।


অভিযানের শুরু আলাস্কায়।


অভিযানের শুরু আলাস্কায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এইস্টেটটি আকারে বিশাল আর জনসংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ মানুষ থাকে রাজাধানী এ্যঙ্করেজে। তাই শহরের বাইরের যে দোকানপাট কম থাকবে তার জন্যই মনে হয় আমরা সদাই পাতি একটু বেশিই করেফেল্লাম। তার জন্য ১৬ জুন সকালে যখন আমরা সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামলাম, আমার ট্যান্ডেম (দুইজন মিলে চালাতে হয় এমন সাইকেল) এর পিছটা এতটাই ভাড়ি হয়ে গিয়েছিল যে আমি কোন ভাবেই সামলাতে পারছিলাম না। বার কয়েক এদিক ওদিক করে শেষটায় আর সমস্যা হলো না।

আলাস্কার সৌন্দর্যের গল্প আগে পড়া হয়েছিল কিংবা টিভিতে যা দেখা, বাস্তব আসলেও আরও বেশি অন্য রকম। এখানে নীল সাগরের মত আকাশ এ দূর পাহাড়ের চুড়া ঢেকে থাকা তুষার গুলো নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে। সবুজ গাছের ঝার আর ঠিক রাস্তার সোল্ডারের মিটার খানেক দূরের বুনো ফুলের সৌর্ন্দয্য আলাস্কার অতি পরিচিত রুপ। এই রুপের সাথে বন্য প্রানীর গল্প আমাদের আগে থেকেই শোনা ছিল। গ্রীজলি বেয়ার দেখলে কি করতে হবে, ব্ল্যাক বেয়ার দেখলে কি করতে হবে তা আমাদরে শোনা হয়েছিল বেশ। তবে তখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারা যায়নি যে আসলেও আমরা বেয়ার দেখতে পাব।

তার মধ্যে জীবনের প্রথমবার মিড নাইট সানের সৌন্দর্যটা আসলেও অসাধারন। প্রথমটা কিছুটা বেগপেতে হয়েছিল, সারা দিন, সারারাতই আকাশে আলো থাকে, তাই আমাদের সকাল হতে শুরু করলো বেশ দেরি করেই। কিন্তু এটা বুঝতে আমাদের সময় লাগলনা যে বেলা পরে যাবার সাথে সাথে রোদের আলো থাকলেও তেজ আর থাকেনা বল্লেই হয়। তাই দুই দিনের মাথায় লম্বা দিনের যে সমীকরন আমরা করে ছিলাম সেটা বদলে গেল। জুন মাসের পূয়োর সামারের জ্বলজ্বলে বিকাল আমাদের হাড় কাপিয়ে দিতে দ্বিধা করতো না।

এটাই নাকি সামার। তা হলে শীত কেমন হবে? ভীষন ঠান্ডার বর্ননা আগেই পড়েছিলাম কিন্তু আচ করতে পারিনি, যা এখন সহজেই অনুমেয়।

আলাস্কায় পাহাড় আছে। উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ মাউন্ট ম্যাককিলি এখানকার ডানালী পার্কেই অবস্থিত। বিশাল আকারের গ্লেসিয়ার গুলোকে রাস্তা থেকেই দেখতে পাওয়া যায়। যা আলাস্কার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়ে বহু গুনে। আর গ্লেসিয়ার থেকে নেমে আসা লেকগুলোর পানি যেন নীল কালি গোলা। অপার নৈসর্গিক দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে সাইকেল চলে যায় পীচ ঢালা পথে। উত্তরের পর্বতের আদিক্ক আর দূরত্ব বেড়ে যাবার কারনেই আমরা ডানালীর পথ ধরিনি । দক্ষিনের পথ ধরে এগিয়েছিলাম কানাডার দিকে। এই পথই সব থেকে ছোট কানাডার বিভার ক্রিক কস্টমস পর্যন্ত।


কানাডার পথে


ঘড়ির সময় ধরে আমরা রাতের হিসাব মিলিয়ে নিতাম কেননা রাত যে কখন হতো তা আমরা বুঝতেই পারতাম না। ক্যাম্প গ্রাউন্ড গুলোও বেশ দারুন। আহামরি না হলেও পাহাড়ের কোণে কিংবা পাদদেশে বা কোন লেকের পাড়ে এমন ক্যাম্প গ্রাউন্ড গুলোতে আমাদের রাতের বেলায় থাকা হতো। খরচার মধ্যে তাবু ফেলার জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা। তবে কিছু কিছু জায়গায় গোসল করার জন্য বাড়তি পয়সা গুনতে হতো। রান্না আমরা নিজেরাই করতাম। সারাহ নিরামিষি হবার কারনে আমাদের রান্না হতো দুই পদের। আমি আর কনক, পাসতা আর সারাহ এর জন্য কিনওয়া। রান্না হতো আমাদে ছোট্ট স্টোভে। সেকি আয়োজন করে সেই রান্না করা! সারা বেলায় এই একবারই আমরা মনের মত করে খেতাম। খাওয়া শেষে তাবুতে।

১২ দিন পরে আমরা বিভার ক্রিক দিয়ে কানাডায় ঢুকলাম। আলাস্কা থেকে বের হয়ে যাবার আগে যেখানে ছিলাম, জায়গাটা আসলেও অসাধারন। একটা গ্যাস স্টেশান, রেস্টুরেন্ট, মোটেল আর মুদি দোকান। তাই আল্লাদে আটখানা আমরা। প্রথমটায় ভাবলাম আলাস্কার শেষ দিনটা আর ক্যাম্প না করি তাই মোটেলের খোজ নেয়া হলো। ওহ! বেজায় খরচ। মোটেল মালিক ও মনে হয় বুঝে গেলেন আমাদের অবস্থা। তাই হেসে বললেন – ঐ সামনের জায়গাটাও আমাদের ওখানে ক্যাম্প করা যায় বিনা পয়সায় আর আমরা যেহেতু সাইকেল চালাচ্ছি তাই আমাদের জন্য খাবার আর ব্যবহারের পানি তার দোকান থেকেই নিতে পারবো। শুধু গোসলের জন্য পয়সা দিতে হবে। আমাদের আপোত্তির আর কিছু ছিলনা।

ছোট্ট একটা কাঠের ব্রীজ পার হয়ে মাঠের মধ্যে চলে আসি। পাশেই দারুন সুন্দও সরু একটা নদী। তার স্রোতের সুরধারায় আমরা ক্যাম্পে করে ফেলাম। যদিও মনে হচ্ছিল এই নদীর পানিতে ঝাপিয়ে পরতে পারলে মনে হয় জীবন স্বার্থক হয়ে যাবে। কিন্তু এত ঠান্ডা পানি আমাদের সহ্য হবে না। তাই সে আশাটা বাদই দিলাম। তবে চারপাশের ঘাসে ঘেরা বিস্তর সমতলে আমাদের তাবুই যেন একটা দ্বীপ হয়ে গেল। আর পরন্ত বিকালের সোনালী আভায় রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিলাম ।


লার্জার দ্যন লাইফ : ইউকন


আলাস্কা থেকে আমেরিকার বর্ডার পার হয়ে আমরা কানাডার ইউকনে ঢুকে গেলাম। এখান থেকে কানাডার কাস্টম আর ২০ মাইল। এই পুরোটা পথ মনে হয় নোম্যন্স ল্যান্ড। আর পথের মস্রিন ভাবটা এবারেই নাই আর। পিচঢালা পথ তবে অনেক পুরোনো তাই মনে হয় উপরের স্তরের ছোট নুরি গুলো ঝরঝওে হয়ে গেছে, যার জন্য জোড়ে সাইকেল চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে যদিও বা শরীরের কষ্টটা হচ্ছে একই।

এই কুড়ি মাইলে থামাও হলো বেশ। পরিবেশটাই কেমন যেন থম থমে। ভাল্লুকের ভয়টাও বেড়ে গেল বহুমাত্রায় । দূরের কোন কালো কিছু দেখলেই মনে হয় ভাল্লুক নাতো? এমনভাবে কতবার যে থামা হলো , গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা হলো, শুধু এটাই জি¹েস করা – – আচ্ছা সামনের কালো জিনিসটা কি ভাল্লুক? অনেকেইহেসে ঠাট্টা করেছেন আবার অনেকে আমাদে অসহায়ত্যটা বুঝতে পেরেছেন। দুই সাইকেলের গতি দুই রকম হবার কারনে ব্যপারটা আরও জটিল আকার হয়ে গিয়েছিল। কখনও কনক ভাই একাই সামনে আবার কখনও সে অনেক পিছনে। পাহাড়ী পথের কারনে কেউ যদি একটু পিছিয়ে পওে তো তাকে আর দেখা যায় না বেশ কিছু ক্ষনের জন্য । আর সে সময়টাতে দুই দলের মানুষের মধ্যেই চলে দারুন শঙ্কা।

বিভার ক্রিকের কাস্টমস একোন ঝামেই হলো না। যদিও বা আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে অনেকের অনেক ধরনের অভিঞ্জতা আছে, আমরাও এমনটা ভাবছিলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। বিনা বাক্যে ঢুকে গেলাম ” লার্জার দ্যন লাইফ” খ্যাত ইউকন প্রভিন্স এ।

বিভার ক্রিক একটা ছোট্ট শহরের নাম। প্রথমে যে গ্যাস স্টেশনটা তার সাথেই একটা ক্যাম্প গ্রাউন্ড আছে। আমরা ওটাতেই হানা দিলাম। বেলা এখনও মেলা বাকি। কিন্তু আজ আর চালাবোনা বলে সবাই সম্মতি দিল।

পাইন গাছের ফাকে আমাদের ক্যাম্প করার জায়গা। আশেপাশে কিছুটা দূরে একটা আরভিও আছে। তবে অন্য কোন ক্যাম্পার দেখতে পেলাম না। সো আমরা আমরাই। সময় থাকায় প্যনিয়ার থেকে জিনিসপত্র বের করে রোদে দেয়া হলো। আর যেহেতু সময় আছে তাই ভাল কিছু রান্না করার জন্য সবাই বসে গেলাম।
শহরটা আসলেও অনেক ছোট। হাটতে বের হয়ে সেটা আরও বোঝা গেল। এখানে কোন এক সময় মনে হয় সোনার খনি ছিল, স্থানীয় ভাবে বলা হয় গোল্ডরাশ।

বিকালের দিকে ফিরে এলাম। কনক ভাইয়ের শরীরটা একটু খারাপ। বেশি খারাপ লাগলে আগামী কালও না চালানর কথাই ভাবলাম আমরা। শুয়ে বসে আর সাইকেল মেরামত করে বাকি দিনটা পার করে দেয়া হলো। আসলে প্রতিদিনের চালনর পর যে সময়টা পাওয়া যায় তা উপভোগের একমাত্র পন্থ্যা হলো আড্ডা দেয়া। আর এর মধ্যেই চলে পরের দিন কোথায় থাকা হবে , রাস্তার পরিস্থিতি কি, দোকান পাওয়া যাবে কিনা ? সারাহ ইনফরমেশন জোগার করতে ওস্তাদ। আমাদে ব্লগের সব লেখাই তার।

ইউকন কানাডার সর্ব পশ্চিমের প্রভিন্সের নাম আর হোয়াইহর্স হলো এর রাজধানী। আর আমরা যাবও এই হোয়াইটহস এ। ইউকন যেন আর বেশিই ফাকা। মাঝে মাঝে গাড়ি গুলোই আমাদের সঙ্গি। এছাড়া চারদিক শুনশান। বেশ ভয়ই লাগে কেননা ইউকনে ভাল্লুকের বিচরন অনেক বেশি। আর তাই আমরা চেষ্টা করছিলাম একসাথে চালানর। এর মধ্যে আমাদেও মতই সাইকেল নিয়ে নিছক আনন্দ লাভের জন্য এই পথেই পাড়ি দিচ্ছে সুইজারল্য ান্ডের মার্টিন আর সিমন। সম বয়সী দুই জনকে দারুন লাগল। আর যেহেতু একই দিকে যাওয়া হচ্ছে তো অলিখিত একটা টিম হয়েগেলাম আমরা।

এইপথে মনে হয় টিমে থাকাটাই ভাল। কেননা ক্যাম্প গ্রাউন্ডগুলোতেও ভাল্লুকের সর্তকবানী। রান্না করার জন্য চলে যেতে হয় খানিকটা দূরে যাতে রান্নার ঘন্ধ তাবুতে না যায়। নিয়ম হলো একটা ত্রিকোণ তৈরি করা। এক জায়গায় রান্না, এক জায়গায় খাওয়া আর এক জায়গায় তাবু। ভাল্লক খুবই ঘ্রানশক্তিশালী প্রানী। তাই এর হাত থেকে বাচার সব থেকে সহজ পথ হলো, তাকে আকৃষ্ট করে এমন কোন কিছু যাতে রাতের বেলা তাবুর আশেপাশে না থাকে। মাঝে মাঝে অবস্থা বেগতিক দেখে খাবারের জিনিসপত্র গুলোকে তাবু থেকে দূরে রেখে আসা হতো। কেউ কেউ রশি দিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়েও রাখত।

পথে ভাল্লুকের দেখাও হয়ে গেল আমাদের। তাও গ্রীজলী। দেখতে বাদামী রং এর এই বিশাল প্রানীটিই সবার যেমন আর্কষনের কেন্দ্র বিন্দু । ঠিক তেমনি মানুষ ভয়ও পায় একে। আমরা প্রতিদিনের মতো আগুপিছু করে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই সামনে খেয়াল করে দেখলাম একটা গাড়ি রাস্তার ডান পাশে থেমে আছে আর সামনের সিটে যিনি বসে আছেন উনি তার মোবাইল দিয়ে ছবি তুলছেন। কিছুটা কাছাকাছি আসতেই শুনতে পারলাম সামনেই গ্রীজলী। তাই সবার আগে আমিই সাইকেলটা থামিয়ে দিলাম। একে একে নেমে গেলাম সবাই। সাইকেলটাকে ঘুরিয়ে আবার খানিকটা পিছিয়ে নিয়ে এলাম। উত্তেজনা সবার মুখে। তবে আমি মনে হয় সব থেকে ভীত। তাই আর আগবাড়াবার সাহস করলাম না। সাইকেল নিয়েই দাড়িয়ে গেলাম। আর সবাই প্রায় মিটার কুড়ি দূরের রাস্তা থেকে ডান দিকে সবুজে ঘেড়া ছোট্ট জায়গাটার কাছাকাছি গেল। তবে কেউ রাস্তা থেকে সরল না। এর মাঝে আরও কয়টা গাড়ীও থেমে গেছে। হু, মাত্র ১০ মিটার দূরেই ভাল্লুক নিশ্চিন্ত মনে মদ্ধান্য ভোজনে ব্যস্ত।

মার্টিন, সিমন, সারাহ আর কনক ভাইকে দেখলাম দূর থেকে ছবি তুলছেন। খানিক বাদে তারা ফিরে এলে তাদের উচ্ছসিত মুখগুলো দেখতে ভাল লাগল। সাইকেলে উঠে গেলাম। যাবার সময় একঝলকের জন্য ডানে তাকালাম – বিশালাকার ভাল্লুকটা তখনও ঘাস খেয়েই যাচ্ছে। প্রানপনে চালিয়ে যতটা দূরে যাওয়া যায় চলে গেলাম। এবার থামার পালা। ছবি দেখতে হবে। সারাহ দারুন ছবি তুলেছে।

সেদিন আরও ঘন্টা তিনেক সাইকেল চালাম। ক্যাম্প গ্রাউন্ডে আবার গ্রীজলীর গল্প সাথে রান্নার যোগার । সে রাতে আড্ডা হল বেশ। তবে একটা ভয় মনের মধ্যে ঢুকে গেছে, হু – ভাল্লুক আছে। আমাদের সাবধান হতে হবে আরও বেশি।

বেওয়াশ ল্যান্ডিংর কথা ইউকনে ঢোকার আগে থেকেই শুনেছিলাম আমরা। ৬টা গ্রীজলী চলে এসেছিল পথের একদম কাছে। গাড়ি চালকেরা আমাদের দেখে প্রায় প্রতিদিনই আপডেন দিত – কোথায় তারা বেয়ার দেখেছেন, কতগুলো দেখেছেন। আমাদের সবথেকে ভয় ছিল এইবেওয়াশ ল্যান্ডিং নিয়ে। এত কথা শোনা হয়েছিল যে মনের মধ্যে সব সময় একটা খচখচ ভাল চলে আসত এর নাম শুনলেই। আজ তাই সবাই আরও বেশি একসাথে, প্রায় কাছাকাছি ভাবে পুরো রাস্তা জুড়েই আমরা। গাড়ি কম াকার যেমন একটা সুবিধা আছে তেমনি আছে ভয়!

আজ আকাশটা সকাল থেকেই কিছুটা ভাড়ী আর গুমোট। সবার মধ্যে ই একটা তটষ্ট ভাব। বিকালের আগে পৌছে যেতে হবে ক্যাম্প গ্রাউডে। তাই সারাটা বেলা আমরা সে হিসেবেই চালালাম। কিন্তু হায় যেখানে আমাদের ক্যাম্প করার কথা সেখানে শুনাশান নিরবতা। এমন কেন? আমরা যে গাইড বইটা ফলো করছিলাম ” মাইল পোস্ট ” সেটাই সবথেকে নতুন আর সেখানেও দেয়া আছে একাট ক্যাম্প গ্রাউন্ড তো বটেই, আরও একটা মোটেল াকার। কিন্তু কোথায়? কোন কিছুই আমরা খুজে পেলাম না। যেন বেমালুম হাওয়ায় মিশেগেছে সব। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধা। আমরা সারাদিন ভাল্লুকের ভয়ে এই অবদ্বি আসার জন্য মড়িয়া হয়ে ছিলাম আর এখন এখানে আসার পর দেখা গেল কিছুই নাই। কি আশ্চর্য!

মোটেলের কাঠের বিল্ডিংটা দেখা গেল কিন্তু মানুষ কই? এর মাঝে ইঞ্জিনের শব্দ কানে আসতে আমরা প্রাণে বায়ুপেলাম। হ্যালো, হাই ই ই!! গাড়ি থামালো, ইজ দেয়ার এনি ক্যাম্প গ্রান্ড এরাউন্ড দিজ প্লেস? ওহহো,নো মোর হেয়ার! ইট ইয়ুজ টু বি, নট এনিমোর। আমাদেও মনে যত শক্তি ছিল তাই সম্বল। আজকের মত অসহায় মনে হয় এই ট্রিপে আর হইনি কখনও, আরও ১৫ মাইল যেতে হবে। আর আজই মনে সূর্যও আমাদেও কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই বাচে।

কিইবা করার আছে। মারাতœক ক্ষুধাও পেয়ে গেছে। যার কাছে যা ছিল তাই খেয়ে রওনা হলাম একাট্টা হয়ে।
আর যতটা দ্রুত চালান যায়। এমন অবস্থায় মনে হয় শরীরও বুঝে যায় বাগড়া দিয়ে লাভনাই। তাই ঘড়ির কাটা ঘুরে যাবার আগেই আমরা পৌছে গেলাম আরেকটা ক্য াম্প গ্রাউন্ডে। ওহ! যা হোক বাচা গেল আজকের মত।


জনশুন্য ক্যাসিয়ার


ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বা বিসিতে আমরা ক্যাসিয়ার হাইওয়ে ধরবো। এটাই সবার ইচ্ছা। তাই ওয়াইটহর্সে আমাদের রেস্ট দে গুলো দারুন কাজে দিল। এখান থেকে আবার সদায়পাতির স্টক করে নিলাম সবাই। এবার সাথে যোগ দিল ক্রিস যার সাথে আমার দেখা হেয়ছিল ১১ বছর আগে এভারেস্ট বেসক্য াম্প ট্রাকিংএর সময়।

ক্যাসিয়ার সম্পর্কে আমরা যতটা পারা যায় যেনে নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। এটা একটা পুরোনো হাইওয়ে। এখন আর আগের মত ব্যবহার হয়না। তাই রাস্তাটা প্রায় পুরোটাই ফাকা াকে। এটাই আমাদের আকৃষ্ট করার অন্য তম প্রধান কারন। তবে রাস্তায় মানুষ কম থাকা মানে জনবসতিও কম থাকবে। তাই বাড়তি খাবার, রান্না করার জন্য স্টোভের তেল, সবকিছুই ডাবল চেক করে নিলাম। বাইকটা আবার বেজায় ভারি হয়ে গেল। কিছুই করার নাই।

প্রথম যেদিন ক্যাসিয়ার উঠলাম, যে রোড সাইটা চোখে পরল তা ক্যাসিয়ার সর্ম্পকে সত্যতার জানান দিল। সামনের ২৩৫ কিমি এর মধ্যে কোন সার্ভিস স্টেশন নেই। মানে নেই কোন দোকান-পাঠ, গ্যাসস্টেশন। তাই ক্যাম্প ও করতে হবে রাস্তার পাশে বা লেকের ধারে। তবে সুবিধাও আছে, এই পথের ক্যাম্প গ্রাউন্ড এর সুমানও শুনেছিলাম।

এগিয়ে যাওয়া শুরু করলাম। কি আর হবে। রাস্তায় নামলে রাস্তা শেষ হয়ে যাবেই। প্রথম দিন নাগেটসিটি ক্যাম্প গ্রাউন্ড থেকে বয়া লেক ক্যাম্প গ্রাউন্ড এ আসলাম। ঢোকার পর আন্দাজ করা যায়নি জায়গাটা কতটুকু সুন্দর। সিমন আর মার্টিন আমাদেও আগেই পৌছে গেছে তাই তাদের ক্যাম্প গ্রাউন্ডেই তাব ফেললাম। তবে সমস্যা করল পাশের আরভি’র মানুষজন। সবে আমরা স্টোভে পাসতা সিদ্ধ করতে দিয়েছি, পানি কেবল ফুটতে শুরু করেছে। পার্কস ক্যানাডার কর্মী এর ক্যাম্প গ্রাউন্ডের তত্বাবধায়ক নিজে এসে আমাদের রিকোয়েস্ট করলেন আমরা যেন অন্য আরেকটা ক্যাম্প সাইটে সরে যাই। একটা সাইটে ৪ জনের বেশি াকা যায় না আর আমরা হলাম ৫ জন। উনি যার পর নাই দু:খ প্রকাশ করে আমাদের লট বহর সরাতে সাহায্য করলেন। সে রাতে লেক থেকে খানিকটা দূরেই াকা হলো। গভীর রাতে ক্রিসও যোগ দিল আমাদের সাথে।
তবে পরদিন সকালে দেখলাম বয়া লেকের রুপ। এমনটা শুধু ছবি কিংবা টিভিতেই দেখেছিলাম তবে বাস্তবে যে এমনটা থাকতে পারে তার ধারনাও ছিলনা।

কেউ আজকে আর নড়তে রাজি না। সত্যিই এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যায়না। না থেকেই গেলাম সবাই। তবে ক্যাম্প সাইটা বদলে নিলাম। তত্বাবধায়ক নিজে এসে আমাদের ঠিক লেকের পাশে ঘাসে মোড়া দারুন জায়গায় ক্যাম্প করার অনুমতি দিলেন। যদিও বা এখানের বাচ্চাদেও জন্য খেলার জায়গা ছিল আর অন্য কারও ক্যাম্প করার অনুমতি ছিলনা। আমরা সাইকেলে আসার কারনেই তার আত্বিক সহযোগীতা পেলাম।
আমরাও ব্যাপক খুশি। এরথেকে ভাল জায়গায় আমরা এর আগে ক্যাম্প করিনি।

একপা গুলেই নীল পানির আধারটা আসলে বিশাল। গতরাতে বোঝা যায়নি আসলে কত বড় এই লেকটা। আমাদেও থেকে কিছুটা সামনেই একটা জেটির মত আছে যেখান থেকে কায়াক নিয়ে লেকের পানিতে ঘোরা যায়। কাঠের ভাসমান পাটাতনে ছেলে বুড়ো সবাইকে দেখলাম রোদে বসা। এমন একটা জায়গায় আসলে কিছু না করেও দিন কাটিয়ে দেয়া যায় । আরও আলস্য আসবে না প্রকৃতিরই অপরুপ শোভা ভোগ করতে।

আমরাও কায়াক নিলাম। প্রায় ২ ঘন্টার মত কায়াক চালালাম। পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেলাম। হাওয়া আর স্রোতের টানে। পানির রং কখনও নীল, গাঢ় নীল আবার কখনও মায়া করা সবুজাভ। কি অদ্ভুত পরিস্কার পানি। লেকের তলা অবদি দেখা যায় অবলিলায়। বালির রংও একে বারে শুভ্র সাদা।

কিছুটা উত্তরের দিকে এগিয়ে ছোট একটা দ্বীপে নামলাম। হাহা! মনে মনে নিজেকে কলম্বাস মনে হলো। তবে নাহ! আমাদের আগে আরও অনেকে এসেছে এখানে। বিভার ড্যাম দেখা গেল। বিভার একটা প্রানির নাম। দেখতে আমাদেও উদেও মত। কম পানিতে নলখাগড়া আর ডালপালা দিয়ে তারা একধরনের বাধ তৈরি করে আর যার নিচে গ্রীষ্ম কালে খাবার সঞ্চয় করে রাখে যাতে শীতের সময় তাদের খাবারের সমস্যা না হয়। বিভার প্রানীটা কানাডার বেশ পরিচিত প্রানীদেও মধ্যে একটা।

দুপুওে সবাই মিলে খাওয়া হলো। তবে রান্নার ঝক্কি কেউ আর পোহাইতে চালনা। শুকনো খাবার যা ছিল তাই। বিকালে দারুন সুন্দও একটা ট্রাকে বের হলাম। ঘন্টাখানেকের ট্রেক। লেকের কোল ঘিরে আকাবাকা পথে এগিয়ে যাওয়া আর পাখির দারুন কলতানে মুগ্ধ হয়ে পরন্ত বিকালের র্তীযক আলোয় লেকের আরেক রুপ উপভোগ করা। আহ।

দিজ লেকে আমরা সব কিছু পাব। শুরু প্রায় তিন দিন পর আমরা দিজ লেকে পৌছলাম। একটা আরভি পার্ক আছে। সেখানেই হানা দিলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য একটা ছোট বোর্ডে লেখা ‘নো টেন্টিং’ । জীবনের প্রথমবার এমন কিছু দেখলাম মনে হয়। বিশ্বাস হলো না। তবে অফিসে কথা বলার পর আমাদের মোহ ভাংল। নাহ, নাছর বান্দা। শুধু মাত্র আরভি’ই এখানে াকতে পারবে। অগত্যা বাজার সদাই করে স্থানীয়দের সাহায্য নিয়ে কাছের একটা লেকের পাড়ে যখন আমরা তাবু ফেলছি, তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা সাথে হঠাৎ করেই নামল বৃষ্টি। তড়িঘড়ি করে আমরা সিমন আর মার্টিনদের তাবুতে ঢুকে নিজেদের রক্ষা করলাম। ভাগ্য ভালই বলতে হয় বৃষ্টি বেশিক্ষন াকলো না। নিজেদের তাবু গুছিয়ে রান্নার বন্দবস্ত যখন করছি তখন পিছিয়ে পড়া ক্রিস আর কনক ভাই চলে এলেন। আর আমাদেও সর্তক করার জন্য স্থানীয় এক ভদ্রলোক এটিভিতে চড়ে আমাদেও বলে গেলেন, এই লেকের পাড়ে ভাল্লুক দেখতে পাওয়া খুব অস্বাভাবীক না। তাই ভাল হলো যদি একটা আগুনের ব্যবস্থা করা যায়। তিনি যেতে না যেতেই আগুনের জন্য কাঠখর খুজে বড়সড় একটা আগুন জ্বালানো হলো। এর মধ্যে সবার জন্য রান্নাও করা হয়ে গেছে। আর অনেকদিন পর লাল চালের ভাতের সাথে ডিম ভাজি খেলাম। ততক্ষনে আমাদের সবার হেড ল্যাম্প জ্বলে গেছে। এই অন্ধকারটা আরও মনে হয় ভাল লাগছিল না। আগুনও উস্কে দেয়া হলো যতটা পারা যায়। খাবারের প্যানিয়ারটাকে যতটা দূরে রেখে আসা যায় রেখে আসা হলো।

তাবুতে ফিরে আর কারও ঘুম আসেনা। এক তাবু থেকে অন্য তাবুকে কথা বলা শুরু হলো। মনে হয় ভাল্লুক তাড়াবাড় জন্যই সবার এই বাড়তি সর্তকতা। ঘুম চলে এল কখন তা বলতে না পারলেও পাখির ডাকে সকাল হলো। কুইক রেডি হয়ে চালানো শুরু করলাম।

ইসকুটে আমাদেও াকার কোন পরিকল্পনা ছিলনা। কেননা বয়ালেকে আমরা দুরাত কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু স্থানীয়দেও মিউজিক ফ্যাস্টিভালটাকে অবহেলা করা গেলনা। তাই আরেকটা রাত বেশি থাকা হলো ইসকুটের ‘সেকরেড হেডওয়াটার গ্যাদরিং’ এ। বাৎসরিক এই অনুষ্টানে দু-তিন দিন গান হয় আর ছোট একটা মেলাও বসে। আমরাও স্থানীয়দের মধ্যে মিশে গেলাম।

ক্যাসিয়ারের সব থেকে মজার বা অতি ভয়াবহ রাত ছিল ‘ বব ক্যুইন ’ এয়ার স্ট্রিপে ক্যাম্প করাটা। না, আর কোথাও ক্যাম্প করার মোত কোন জায়গা ছিলনা। সেই রাতে যত পদের জন্তু জানোয়ারের আওয়াজ পেয়ে ছিলাম তা আর কোথাও পাইনি। এয়ার স্ট্রিপটাতে ছোট আকারের প্লেন নামে। তাই কোন অফিস নেই। একটা বিশালাকার তেলের ট্যাংক আর বিশাল একটা ফাকা জায়গা, ব্যাস। আমাদের আর দরকার ছিল পানি, যা রাস্তার পাশের ঝিরি থেকে সংগ্রহ করা হলো। আর কোন কিছুর দরকার আমাদের সে রাতে আর লাগেনি।

মেজিয়াদিন লেকটাও দারুন ছিল যা জন্য এখানেরও আমাদের দুরাত থাকা হলো। লেক ক্যাম্প গ্রাউন্ড থেকে বেরুবার পর কিছুটা উপরের দিকে উঠতে হয় কিন্তু তার পর রাস্তা আসলেও দারুন। সিমন-মার্টিন চলে যাবে অন্য দিকে। ওরা হাইডেন এর দিকে যাবে আর তার পর ভ্যানক্যুভার আইল্যান্ডের দিকে। আর আমরা টরোন্টো। একটা দক্ষিণমুখী আরেকটা পূর্ব।


অনেক রাইডের পর ঈদ এল জেসপারে


এ্যালবার্টার জেসপারে আমরা ঈদ করবো এমটাই পরিকল্পনা। জ্যাসপার শহরটাই একটা পার্কের মধ্যে। পার্কস কানাডার অন্যতম জনপ্রিয় এই পার্ক। আসলে পার্ক বলতে আমরা যা বুঝি, এখানকার পার্ক গুলো পুরোই আলাদা। আয়তনে আমাদের দেশের থেকেও খানিকটা বড়ই হবে মনে হয়। জন্তু জানোয়ার থেকে শুরু করে সবই আছে। তবে এটাকে চিড়িয়াখানা বলাটাও ভুল হবে। জ্যাসপার শহরটাই দারুন। আকাবার পাহাড়ী পথে উঠে গিয়ে ছোট্ট একটা শহর। আসলে শহরই বলা যায়। সবই আছে। মূলত ট্যুরিস্ট নির্ভর ইকোনমি। তাই রাস্তার পাশের ক্যাফে গুলোও বেশ জমজমাট। দুএকটা হোটেল দেখলাম কিন্তু তার যে চড়া দাম হবে তা আর বলতে। নাহ, আমাদের ইচ্ছাও ছিলনা।

শহর থেকে ৫ কিমি দূরে প্রথম ক্যাম্প গ্রাউন্ড। হুইসলার! আমাদের দেখা সবথেকে বড় ক্যাম্প গ্রাউন্ড এটা। ৮৪০ টার বেশি ক্যাম্প সাইট। আমার মনে হয় এটাই পৃথিবীর সব থেকে ক্যাম্প গ্রাউন্ড। জ্যাসপার শহরের মোট জনসংখ্যা সিংহভাগ যে এখানে থাকে তার আর বলতে।

ঈদ এখানেই করা হবে। তাবু ফেলে সেদিনে মত আর কিছু করা হলো না। পরের দিন শহওে গিয়ে রাতের খাবার কিনে আনা হলো। কাল ঈদ। সকালে উঠে আর নামাজের ঝামেলা নাই। দেরি করেই উঠলাম। সকালের নাস্তা যথা বিহীত ওটমিল। বেলা একটু বাড়ার সাথে সাথে আমরাও নতুন জামাকাপড় পরেনিলাম। বিশেষ কিছুটা। ফতুয়া। আর সারাহ পরেছিল শারী। আমরা যখন এমন বেশভুশ নিয়ে রেডি হচ্ছিলাম তেখন দেখা গেল আশেপাশের ক্যাপগ্রাউন্ড থেকে আমাদের দিকে উকি দিচ্ছে কেউ কেউ। একজন কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে সারাহকে জি¹েসই করে বসলো, এটা কেমন ড্রেস! ঈদের বর্ননা দিয়ে আমরা সাইকেল নিয়ে বের হলাম। এমন কসটিউম দেখে আমাদেরকে যে সবাই আড়চোখে দেখছে তা বুঝতে পারলাম।

ঢাকাতেও একই ট্যান্ডেমে আমরা একই রকম পোশাকে ১ম বৈশাখে সাইকেল চালিয়েছিলাম বটে তবে এখানে বেশ আলাদা। রাস্তা যেহেতু উচু নিচু তাই প্যাডেল করাটাও বেশ কষ্টের।

একটা সড়ক দ্বীপে সাইকেল রাখার জায়গা ছিল, ওখানে সাইকেল রেখে ছোট বেলায় আমরা যেমন পাড়া বেড়াতাম ঈদের দিন, আজও তাই করলাম। এরথেকে বিশেষ কিছু করার নাই আমাদের। খারাপ লাগলো না। তিনজন মিলে এটাওটা কিনে, গত কয়েক সপ্তাহের যে লন্ড্রি বাকি ছিল তা করে সন্ধার আগে ক্যাস্প গ্রাউন্ডে ফিরে এলাম।

বেশ কয় পদের রান্না করা হলো। আহ আজ আবার ভাত খাওয়া হবে। ভাত করতে একটু সময় বেশি লাগে এই যা। না হলে ভেতো বাংগালীর জন্য ভাত ছাড়া আর কিছুতে পেট ভরলেও মন ভরে না।

আমাদের মকবুলে মকসুদ হলো ব্যান্ফ। লেক লুইস হয়ে আমাদের যেতে হবে। কিন্তু তার আগের দিন গুলোতে আমাদের দারুন ঝক্কি পোহাতে হলো ক্যাম্প করতে গিয়ে। ৪ দিনে লম্বা ছুটিতে সবাই এখন ঘরের বাইরে আর তাই আমরা যে জায়াগা গুলোতে ক্যাম্প করব সে জায়গা গুলো আগে থেকেই বুক্ড হয়ে ছিল।

সব থেকে বড় উদাহরন লেক ল্যুইজ। দুইটা বিশাল আকারের ক্যাম্প গ্রাউন্ড তার উপর আছে অনেক পদের হোটেল-মোটেল। ক্যাম্প গ্রাউন্ডটা দূরের াকায় আর ক্লান্ত লাগার জন্যই মোটেল দেখলাম? বিদ্ধস্ত সারাহকে দেখেই মনে হলো খবর ভাল না। সব থেকে কমদামের রুমের ভাড়া হলো ৩৪০ ডলার তার উপর আবার ট্যাস্ক আছে। হোস্টেলে গেলাম। বলে কি? ৪৫ ডলার করে করে একজনের? নাহ! আমাদের জন্য ক্যাম্পই ভাল।

পরের দিন ব্যান্ফ। এইশহর আমাদের কাছে আগে থেকেই পরিচিত ছিল মাউন্টেন ফিল্ম ফ্যাস্টিভালের জন্য । তাই ছবি বা ভিডিও দেখা হলেও একটা শহর যে আসলেও এতটা সুন্দর হতে পারে ধারনা করাও যায়না। রোড সাইন দেখে ব্যান্ফ সেন্টারের দিকেই এগোলাম। ওখানেই আমাদেও পরের কতগুলো দিন থাকার হলো।
এটা একটা আটর্ ইন্সটিটিউট যেখানে বিভিন্ন দেশের মানুষজন আশে পড়ালেখা করতে। আমাদের াকার ব্যবস্থা হলো এখানেই। এতদিন পর মত হলো সভ্যতার কত কাছাকাছি থেকেও আমরা আদতে কত দূরেরই ছিলাম এতদিন।

বন্ধুদের সাথে ডিনারে অনেক আড্ডা হলো। পেট পুরে খাওয়াও হলো। কেউ কিছু মনেও করলো না। এটা আর বলে দিতে হয়নি আমাদের ক্ষুধাটা এখন কতবেশি। ক’সপ্তাহ আগে ২৩ ডলারের পেট চুক্তি বাফেটে আমরা ৭ জন এতই খেয়ে ছিলাম যে তাদের খাবারে সংকটা দেখা দিয়েছিল – এ গল্প ব্যান্ফ মাউন্টেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ওয়ার্ল্ড ট্যু’র ম্যনেজার জিম আর কারিনকে করেছিলাম যাতে করে তারা আমাদে খাওয়া দেখে ভীমরি না খায়।

এখান থেকে কনক ভাই চলে গেলেন ঢাকায়। ক্যালগারি থেকে তার ফ্লাইট আর ক্রিসও আমাদেও সাথে তাল রাখতে না পেয়ে একাই চালাচ্ছে। এখন থেকে আমি আর সারাহ।


অবশেষে বাংলাদেশী


ষাটতম দিনে পরন্ত বিকালে যখন আমরা সাসকাচিওয়ানের এলরোজ নামে ক্ষুদ্র শহরটাতে ধুকছিলাম – আমাদের কেউ ডাকছে এমন একটা আওয়াজ পেলাম। কিছুটা যাবার পর সারাহ আমাকে সাইকেল ঘুরাতে বলল। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে আসতে না আসতেই আমার মত দেখতে একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। সাইকেলে বাংলাদেশের পতাকা দেখে তিনি আর তার স্ত্রী ডাকাডাকি শুরু করেছিলেন। হু, ৬০ দিন পর প্রথম কোন বাংলাদেশীর দেখা পেলাম। বাংলা খাবার, দুই দিনের বিশ্রামে আমাদের শরীর আবার চঙ্গা।

সাসকাচিওয়ান সব থেকে সমতল প্রভিন্সই বলা যায়। চালাতেও বেশ আরাম। আর সব থেকে বড় কথা হলো মানুষ গুলো খুবই ভাল আর ভীষন অতিথি পরানয়। ক্যাম্পগ্রাউন্ডে পানি না াকার জন্য পাশের বাড়ি থেকে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন আমাদেও সাহায্য করতে পরে তিনিই আমাদের তার বাড়িতেই ঠাই দিলেন। নিয়ে গেলেন বিখ্যাত ‘ব্যারল রেস’দেখানার জন্য । এরপর ডাইনোসর ন্যাশনাল পার্কেও দিনটা ছিল মুগদ্ধ হবার মত। ‘ব্যাড ল্যান্ড’ নামে খ্যাত এই পার্কেই পাওয়া গেছে ডাইনোসরের ফসিল। শুধু তাই না পরের দিন তাদেরর আরেক বন্ধু নিমন্তন্য গ্রহন করে আবার যাত্রা শুরু করলাম।

সারাহ’র জন্মদিন উইনিপেগে

মেলভিল থেকে আমরা মেনিটবার ইয়র্কটনে যাওয়ার দিনটা আমাদের জন্য সবথেকে কষ্টকর একদিন। ১২৫ কিমি করতে হবে আজ। সারাদিন ভাল গেল কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হলো বিকালের দিকে। প্রথমে কিছুটা মেঘ মেঘ তার পর হুট করে ভিষন বৃষ্টি আর হাড় কাপানো ঠান্ডা বাতাস। সোল্ডার দিয়ে চললেও যেকোন বড় গাড়িই আমাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় রাস্তায় জমে াকা পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল। যা রীতিমত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল কেননা অল্প সময়ের জন্য হলেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আর মাত্র ৫ কিমি, এবার মরার উপর খারা ঘা, চাকা পাংচার হয়েগেল। এই বৃষ্টিতে বাক্স পেটরা খুলে সেরে চালানো শুরু করার পর বুঝতে পারলাম সমস্যার পুরো সমাধান হয়নি এখনও। পিছনের চাকার হাওয়া াকছেনা। বেশ খানিটা সময় রাস্তার পাশেই অপেক্ষা করা হলো যদি না বৃষ্টি কিছুটা কমে। কিন্তু কৈ? ামার কোন লক্ষনই দেখা গেলনা। অগত্যা সারাহ একটা গাড়ি ামিয়ে কিছু মাল পত্র নিয়ে শহরের দিকে গেল আর আমি সাইকেলটা চালিয়ে শহরের দিকে যাওয়া শুরু করলাম এই বৃষ্টির মধ্যে । মিনিট কুড়ি পরে একটা গাড়ি আমার সামনে ামাতে বুঝতে পারলাম সারাহই এটা ম্যানেজ করেছে। ঝটপট গাড়িতে উঠে বাকি কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে শহরে পৌছে গেলাম।

সারাহ’র জন্মদিন করা হবে উইনিপেগে। ম্যানিটেবার রাজধানী। শহর হিসেবে বড় না। স্টেলা নামের বিখ্যাত ক্যাফেতে আমরা ডিনার করতে গেলে ক্যাফে ম্যানেজারের সাথে কথা প্রসঙ্গে আমাদেও রাইডের কথা বলতেই খুবই উৎসাহ প্রকাশ করলেন। আর গিফ্ট হিসেবে দিলেন তাদের তৈরি গ্রেনোলা আর রাসবেরির জ্যাম! তাদের আতিথীয়তার কথা আমাদের অনেক দিন মনে থাকবে।


টরোন্ট হেয়ার উই কাম : ওন্টারিও


উপসালা হয়ে সাবাকোয়ার পথ ধরে আমরা থান্ডার বে’তে আসলাম। সাইকেলটায় কিছু সমস্যা হচ্ছিল আর ান্ডার বে ছাড়া আর কোথাও বাইক শপ পাওয়া যাবে না। ফাজিম নামের এক ভদ্রলোক আমাদের সাইকেল সাড়িয়ে দিলেন। ইরানী এই ভদ্রলোক গত ৪০ বছর ধরে বাইক ঠিক করে আসছেন। দারুন সব টিপস দিলেন। বললেন কখন কি করতে হবে কোন সমস্যায়। আমার বাইক ম্যাকানিক দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কালে কালে কিন্তু এনার মত মনে হয় একজনকেও পাইনি। কোন টাকা চার্য করলেন না। নিখাদ ভালবাসায় বুকে জড়িয়ে বললেন – বাইক সেফ। আনন্দ অশ্রুতে চোখ ছলছল আমাদের। পিছু হঠে এলাম দ্রুত। ঘর ছাড়ার পর প্রায় ৩ মাস হয়ে গেছে, কত মানুষ কত ভাবে যে আমাদের সাহায্য করেছে তার হিসাব মেলানো মুশকিল!

ওন্টারিয় আমাদের শেষ প্রভিন্স। থান্ডারবে হলো এর শুরু। লেক সুপিরিয়র ধরে আমাদেও এগিয়ে যেতে হবে। এই পথ সম্পর্কে ভাল কোন কিছু আগে শুনিনি আমরা। চাড়াই উৎরাইয়ের সাথে আছে পৃথিবীর সবথেকে বড় মিঠা পানির আধার এই লেক সুপিরিয়রের দমকা হাওয়া। যেদিন রাস্তা সমতল থাকে না, সেদিন থাকে বাতাস। আবার যেদিন বাতাস থাকে না সে দিন হয় রাস্তা কঠিন নয়তো আমার পায়ের সমস্যা দেখা দেয় দারুন ভাবে।

এভাবেই নিপিগন, রসপোর্ট,টেরেন্সবে, মারাথন হয়ে ওয়াওয়াতে চলে এলাম। পুরো রাস্তাটাই লেকের পাড় ধরে। কখনও আমরা লেকের পানিতে পা দিয়ে আয়েক করে দুপুরের খাবার খেয়েছি আবার কখনও বা লেকটাকে দেখেছি অনেক উপর থেকে। যত ভাবেই দেখা হোক, এই লেকটা যতনা সুন্দও তার থেকে বেশি হলো এর আকার। বিশাল একটা ব্যপ্তি। সাগর বললেও ভুল হয় না।

এসপেনোলা’য় যাওয়ার জন্য আমরা হাইওয়ে ৬ ধরলাম। বহুদিন হাইওয়ে ১৭ এ ছিলাম। তাই একটা মায়াও পরে গিয়েছিল। এই হাইওয়েতেই প্রায় ১১০০ কিমি সাইকেল চালিয়েছি। ৬’ ধরে এসপেনোলা হয়ে ম্যনিটুলান আইল্যান্ড। যেতে হবে ফেরিতে করে। আমাদের গন্তব্য খুব বেশি দূরে না আর।

চিচিমান এর ফেরি রাইডটা দারুন ছিল। অনেকদিন পর একটা ব্যতিক্রম কিছু করার মধ্যে একধরনের আলাদা আনন্দ। তবে টবলমুরির ঘাটে ফেরি যখন পৌছাল, আমার ডান পায়ের সীনের ব্যাথাটা বেশ ভাল ভাবেই অনুভব করতে পারলাম। পা আর ফেলতে পারছিলাম না। অগত্যা এখানে একদিন বেশি াকাই শ্রেয় মনে হলো। সারা দিন পায়ে বরফ দিয়ে রাখলাম। রাতে ব্যথাটা কিছুটা কমায় পরদিন সকালে ওয়ারটনের দিকে রওনা হলাম। এদিকে গ্রীস্মের উষ্নতা কমে গেছে তাও ২ সপ্তাহ হবে। দোকান পাঠবন্ধ হয়ে যাবে পরের সপ্তাহে। রাতের তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের নীচে আর সকালটা থাকে দারুন ঠান্ডা। আজ আর কান টুপি ছাড়া সাইকেল চালানো সম্ভব হলো না। মাঝ দুপুরের কিছুটা রোদে ঠান্ডার ভাবনা কমলেও জ্যাকেট খুলে রাখা অসম্ভব। টেনে হেচরে মার্কডেলে আসলাম এক ভদ্রমহিলার সাহায্যে কোন মতে শহরের একটাই মাত্র মোটেলে উঠলাম।

নাহ! পা আর চলছেই না। বিশ্রাম ছাড়া কোন উপায় নাই। টরেন্ট আর মাত্র ১২০ কিলোমিটার।

মোটেলের বাইরে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনে পড়লো, এইতো কদিন আগেই রাইডটা শুরু হয়েছিল, আজ প্রায় শেষের পথে। আর মাত্র কিছু পথ। যদিও পায়ের অবস্থা ভাল না তবুও আশাবাদী।

রেস্ট নিলাম। পায়ে বরফ দিলাম, কাজ হলো না দুই দিনেও। আর যতটুকু বুঝতে পারলাম, আরও সময় লাগবে। অগত্যা বন্ধু সরনাপূর্ন হলাম। গাড়িতে করে শেষ পথটুকু পাড়ি দিয়ে টরোন্ট পৌছলাম। আজ আমাদেও রাইডের ৯৫তম দিন।

মোট ৫৭৮৬ কিলোমিটার চালিয়েছি আমরা, যদিও মূল পরিকল্পনায় ছিল আর কিছুটা বেশি। শারীরীক অসুস্ততা আর অন্যান্য কারনে বাকি পথটুকু আমরা যানবাহন ব্যবহার করেছিলা ।

টরোন্ট থেকে নিউ ইয়র্ক হয়ে ঢাকায় ফিরে আসতে আসতে মোট লেগে গেল প্রায় ৫ মাস।


Published on bdnews24.com 
on May 21, 2015, updated December 15, 2015

Leave a Reply